আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ● ১০ আশ্বিন ১৪৩২
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
রংপুরে সেই বাগছাস নেতার পদ স্থগিত

শ্রেণিকক্ষে ঢুকে শিক্ষার্থী পেটানো
রংপুরে সেই বাগছাস নেতার পদ স্থগিত

মুন্সীগঞ্জে বাসচাপায় মাদ্রাসা ছাত্রী নিহত, বাসে আগুন বিক্ষুব্ধ জনতার

মুন্সীগঞ্জে বাসচাপায় মাদ্রাসা ছাত্রী নিহত, বাসে আগুন বিক্ষুব্ধ জনতার

‘সবগুলাকে ফাঁসি দিছি, তোদেরও ছাড়বো না’, শিক্ষার্থীদের বিষয়ে হুংকার হাসিনার

‘সবগুলাকে ফাঁসি দিছি, তোদেরও ছাড়বো না’, শিক্ষার্থীদের বিষয়ে হুংকার হাসিনার

আন্দোলনের সময় হাসিনাকে ‘জঙ্গি কার্ড’ খেলার কথা বলেছিলেন ইনু

আন্দোলনের সময় হাসিনাকে ‘জঙ্গি কার্ড’ খেলার কথা বলেছিলেন ইনু

তিস্তায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে মহোৎসব,বেড়েছে নদী ভাঙ্গন

বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, দুপুর ০২:৪৩

Advertisement

বিশেষ প্রতিনিধি॥ উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদী বিধৌত এলাকা হচ্ছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা। দেশের সর্ববৃহৎ ও অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা সেচ প্রকল্প, যার মূল অংশ তিস্তা ব্যারেজ। এই উপজেলার সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বয়ে আসে তিস্তা নদীর পানি। এই নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে ফসলি জমি, বসতবাড়ি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্মিত বাঁধ। 
কিন্তু উত্তরবঙ্গের প্রাণখ্যাত তিস্তা নদী এখন এক ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় দিন-রাত চলছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। প্রভাবশালী চক্রের মদদে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যবহার করে নদী থেকে অবাধে তুলে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর। এর ফলে একদিকে যেমন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ভাঙনের কবলে পড়ে ভিটেমাটি হারাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। ​প্রতিদিন উপজেলার বাইশপুকুর, চরখড়িবাড়ি, একতা বাজার, তেলির বাজার, তিস্তা বাজার, কালিগঞ্জ ও ছোটখাতা গ্রোয়েন বাঁধসহ অন্তত ১৫-২০টি স্থানে চলছে এই ধ্বংসযজ্ঞ।
এলাকাবাসী বলছেন, ‘সিলেটের সাদা পাথরের ন্যায় তিস্তার পাথরও লুট করা হচ্ছে। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় শক্তিশালি হয়ে উঠছে এই চক্র। অসাধু কর্মকর্তারা পকেট হয়ে যাওয়ায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।’ 

এদিকে তিস্তা নদী থেকে অবৈধ ভাবে পাথর বালু উত্তোলনে প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে জেল-জরিমানা সহ বিপুল পরিমাণ পাথর জব্দ করার পরেও নীলফামারীর ডিমলার তিস্তাপাড়ে থামানো যাচ্ছে না অবৈধ পাথর বালু উত্তোলনকারী চক্রকে। দিন দিন চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করছে এলাকাবাসী। অপরদিকে নদী থেকে অবৈধ ভাবে পাথর বালু উত্তোলনে তিস্তার গতিপথ পরিবর্তন এবং ফসলি জমি, বসতভিটা ভাঙনের কবলে পড়ছে। এছাড়া শতশত ট্রলি দিয়ে নদীর পাড় থেকে পাথর পরিবহন করায় তিস্তার ডানতীর প্রধান বাঁধ ও গ্রামীন রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ‘প্রতিদিন নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। তিস্তা নদীর দুই পাড়ের গ্রামগুলো নদীভাঙনের কবলে পড়ে ফসলি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ছোটখাতা তফেল মেম্বারপাড়া, বাইশপুকুর, সীমান্ত এলাকা কালিগঞ্জ, বার্ণিরঘাট বিজিবি ক্যাম্প এলাকা ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এলাকার আজগার নামের একজন জানালেন ভাঙন এলাকায় শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকায় লোহার তৈরি যন্ত্র দিয়ে নদীর তলদেশে গভীর গর্ত করে পাথর উত্তোলন করছে এলাকার একাধিক প্রভাবশালী চক্রের লোকজন। যা তিস্তা ব্যারেজের অদুরে, তিস্তা বাজার, তেলির বাজার, চরখড়িবাড়ি, বাইশপুকুর, কালিগঞ্জ, ভেন্ডাবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় পাথর উত্তোলনে প্রায় ১৫টি প্রভাবশালী চক্র জড়িত রয়েছে। পাথর উত্তোলনে শতশত ইঞ্জিন চালিত নৌকা ব্যবহার করা হচ্ছে। নৌকা চলন্ত অবস্থায় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত পাখা দিয়ে নদীর তলদেশের বালু সরিয়ে পাথর তুলে পানির ওপরে নিয়ে আসা হয়। এভাবেই নদীর বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় টিম পাথর উত্তোলন করছে। উত্তোলিত পাথর স্থানীয় সিন্ডিকেটটি ক্রয় করে জমজমাট ব্যবসা করে আসছে।’

নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা ও বেশকিছু স্থানীয় লোকজন জানান, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নিজস্ব সন্ত্রাসবাহিনী লোকজন দিয়ে আগুন খাওয়া টিম তৈরী করে পাথর উত্তোলন করতো। স্থানীয় গোলাম মোস্তফা নামের এক ব্যাক্তি উচ্চ আদালতে রিট দাখিল করলে আদালত তিস্তা নদী থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করে দেয়। দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর ফ্যাসিস্ট দল গেলেও এখন নতুনরূপে আরেকটি আগুন খাওয়া দল তৈরী হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ‘নদীর পাড় থেকে বিভিন্ন স্থানে পাথর পরিবহনের ট্রাক্টর থেকে পানি পড়ার কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ডান তীর প্রধান বাধ ও স্থানীয় সড়কের বেহাল অবস্থা হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে পাথর পরিবহন। যা নদীর পাড় থেকে সঠিবাড়ি বাজার, ডালিয়া বাজার সড়কের ধারে স্তুপ করে রাখা হয়। সেখান থেকে রাতারাতি পাথর বিক্রি করা হচ্ছে। অপরদিকে অবৈধভাবে পাথর-বালু উত্তোলণ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি । অনেকে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘সিলেটের সাদা পাথরের ন্যায় তিস্তার পাথরও লুট করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারনে নীলফামারীর ডালিয়াস্থ্য তিস্তা ব্যারেজের ভাটি এলাকা হুমকির মুখে পড়েছে। প্রতি নিয়ম নদী ডান তীরে সরে আসছে। তিস্তা নদীতে বড় ধরণের বন্যা আসলে নদী রুদ্ধস্ত রূপ ধারণ করে শত শত এলাকা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।’

সূত্র মতে, ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর সিকিমে ভয়াবহ বৃষ্টির জেরে বড় বন্যা হয়েছিল তিস্তায়। ওই সময় পলি পড়ে তিস্তায় নাব্যতা কমে যায়। নদী মাঝখানে আর নাই। নদীর দিক পরিবর্তনে কখনও বামতীর, কখনও ডানতীরে সরে যাচ্ছে। ফলে কয়েকদফায় অতিভারি বৃস্টি ও উজানের তীব্র স্রোতে তিস্তা নদী দিক পরিবর্তন করে ভয়াবহ ভাঙ্গনের পরিস্থিতি সৃস্টি করেছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়নে ভেন্ডাবাড়ি নামক স্থানে এক নম্বর স্পার বাঁধে ধ্বস নামে। এতে সেখানকার ডানতীরে প্রধান বাঁধটিঝুঁকির মধ্যে পড়ে। সেদিন ভাঙ্গনরোধে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, এলাকার শ্রমিক ও জরুরীভিত্বিতে ঠিকাদার জিও ব্যাগ, জিও টিউব, বাঁশ ও গাছের গুড়ির পাইলিং করে ভাঙ্গনরোধ করে।

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) এ ব্যাপারে কথা বলা হলে তিস্তাপাড়ের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ‘তিস্তা নদীতে পাথর বা বালু মহল নেই। এছাড়া নদী থেকে পাথর বালু উত্তোলনে নিষেজ্ঞাধাও রয়েছে। নদীর বালু, পাথরের উত্তোলনের বিষয়ে দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের। তিনি আরও বলেন, নদীর ভাঙন রোধে বা বাধ সহ বিভিন্ন অবকাঠানো রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। ক্ষতি হলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

অপরদিকে কথা বলা হলে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইমরানুজ্জামান বলেন, ‘‘নদী বা মাটির তলদেশ থেকে পাথর ও বালু উত্তোলনের আইনগতভাবে কোন সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলেই ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। তিনি জানান, গত রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) অভিযান চালিয়ে উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত মেশিন ও উত্তোলনকৃত বিপুল পরিমাণ বালুর স্তুপ জব্দ করা হয়। এ সময় অভিযুক্ত আব্দুল করিমকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া গত ২০ আগষ্ট  অভিযান চালিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাড়ে ৫ হাজার সিএফটি পাথর জব্দ করা হয় বলে উল্লেখ করে তিনি জানান সকল অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান। ’’

​তবে এলাকাবাসীর মনে প্রশ্ন থেকেই যায়, প্রশাসনের অভিযান সত্ত্বেও কেন কিছুদিন পর সেই নৌকাগুলো আবার গর্জন তুলে নদীর বুক খুঁড়তে শুরু করে? তিস্তাপাড়ের মানুষ আজ এক অনিশ্চয়তার স্রোতে ভাসছে, যেখানে প্রতিদিন তাদের ভিটেমাটি একটু একটু করে নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে। ​এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগে, তিস্তাপাড়ের মানুষের ভবিষ্যৎ কী? তাদের কি আবারও নদীভাঙা উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে হবে? নাকি সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে তিস্তাকে বাঁচিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করা সম্ভব হবে? 

মন্তব্য করুন


Link copied