স্টাফরিপোর্টার,নীলফামারী॥ নীলফামারী উত্তরা ইপিজেডে শ্রমিক অসন্তোসের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে হাবিব ইসলাম (২০) নামের এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। নিহত হাবিব ইসলাম ইকু ইণ্টারন্যাশনাল নামের একটি নিটিং কারখানায় কর্মরত ছিলেন। নিহত শ্রমিক জেলা সদরের সংগলশী ইউনিয়নের কাজীরহাট মাছিরচাক গ্রামের মো. দুলাল হোসেনের ছেলে। মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালে এ ঘটনা ঘটে। এতে দুই নারী শ্রমিক সহ ৭ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে তিনজনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
এদিকে বিকাল ৫টার দিকে নিহত শ্রমিকের মরদেহ নিয়ে নীলফামারী-সৈয়দপুর সড়কের ইপিজেডের সামনে শ্রমিকরা অবরোধ করে রাখে। সেখানে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড এলাকা পরিদর্শন করেন এবং নিহতের পরিবারকে শোক-সন্তপ্ত সান্তনা দেয়ার সময় তিনিও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
এ সময় রংপুর রেঞ্জের ডিআইজির কাছে নিহক হাবিবের সহকর্মী ও আত্বীয় স্বজনরা দাবি জানান, আমাদের ভাইয়েরা যদি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করতো, তাহলে সেটি আলাদা বিষয় ছিল। কিন্তু কোনো ক্ষতি না করেও সাধারণ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালোনা হলো কেন? এটি বিচার চাই।
এ বিষয়ে নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, দুপুরে আমরা সেনাবাহিনী, বিজিবি, ইপিজেড কর্তৃপক্ষ, এভারগ্রীন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংঘঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছি। শ্রমিকদের ২৩ দফা দাবির বিষয়ে পর্যালোচনা করেছি। শ্রমিকদের যে অভিযোগ ছিল সে সব তদন্তে বেপজা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবে। যৌক্তিক দাবিগুলো ইপিজেড বাস্তবায়ন করবে।
আর নিহত হাবিব ইসলামের পরিবারকে আপাতত ২ লাখ টাকা দিয়েছে এভারগ্রীন কর্তৃপক্ষ। আহতদেরও ক্ষতিপুরণ দেয়া হবে বলে জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ওই ঘটনায় ৭জন শ্রমিক আহত হয়ে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ৩জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। ওই ঘটনায় দুইজন আনছার সদস্য, ৭জন পুলিশ সদস্য, ৪ জন সেনা সদস্য ও একজন বেপজার সদস্য আহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সেখানে দুই প্লাটুন বিজিবি, পুলিশ ও সেনা মোতায়েন রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কারখানাগুলো চালু করা হবে।
কারখানা শ্রমিকরা জানায় ইপিজেডের এভারগ্রীন নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি ৫১জন শ্রমিককে ছাটাই করে। এ নিয়ে গত তিনদিন ধরে সেখানে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এ অবস্থায় শ্রমিকদের বেতন ভাতা না দিয়েই মঙ্গলবার (২সেপ্টেম্বর) থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এভারগ্রীন কারখানা বন্ধ ঘোষনা করে ইপিজেডের প্রধান ফটকে নোটিশ টাঙ্গিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ।
মঙ্গলবার সকালে কাজে যোগ দিতে গিয়ে এভারগ্রীনের শ্রমিকরা ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে ইপিজেডের সামনের সড়কে অবস্থান নেয়। এ অবস্থায় নীলফামারী- সৈয়দপুর সড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সড়িয়ে দিতে গেলে উত্তেজিত শ্রমিকরা তাদের ওপর চড়াও হয়। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালালে হাবিব ইসলাম ঘটনাস্থলে নিহত হন। আহত হন আরো প্রায় ১০জন। এদের মধ্যে ৭জনকে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহতরা হলেন, মো. মোমিনুর রহমান (২৫), মো. শাহিন (২৬), নুর আলম (৩০), মোস্তাক আহমেদ (২৫), লিপি আক্তার (২৬), জমিলা খাতুন (৩৫) ও শামীম হোসেন (৩৫)। এদের মধ্যে মো. শাহিন, লিপি আক্তার ও শামীম হোসেনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে নীলফামারী- সৈয়দপুর সড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হস্তক্ষেপে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ইপিজেড এলাকায় সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদের মোতায়েন থাকতে দেখা যায়।
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ফারহান তানভিরুল ইসলাম বলেন, সকাল সারে আটটার দিকে হাবিব ইসলামকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। সে কিভাবে মারা গেছে সেটা ময়নাতদন্ত না করে বলা যাবে না। এ ছারা আহত ৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনজনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আহতরা কিভাবে আহত হয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, আহতরা বলেছেন তারা গুলি দ্বারা আহত হয়েছেন। দেখে সেরকমে মনে হয়।
এদিকে নিহত হাবিব ইসলামের লাশের ময়না তদন্তের জন্য নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের একটি কক্ষে রাখা হয়। বিকেল ৪টার দিকে নিহতের স্বজন ও এলাকাবাসী ময়না তদন্ত ছাড়াই জোরপুর্বক তালা ভেঙ্গে সেখান থেকে হাবিব ইসলামের লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এরপর তারা লাশ নিয়ে ইপিজেডের সামনে সড়ক অবরোধ করে রাখে।
এ বিষয়ে কথা বললে নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আর সাঈদ বলেন, নিহত হাবিব ইসলামের লাশের ময়না তদন্তের জন্য তার লাশ নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের একটি কক্ষে রাখা হয়। কিন্তু তার পরিবারের লোকজন ময়না তদন্ত না করার দাবি করেন। এক পর্যায়ে তারা কক্ষের তালা ভেঙে জোরপুর্বক লাশ নিয়ে গিয়ে ইপিজেডের সামনে সড়ক অবরোধ করেছে। সেখানে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করেছেন ও নিহত পরিবার ওশ্রমিকদের কাথে কথা বলেছেন। আমরা আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে ময়না তদন্তের মাধ্যমে লাশ দাফনের জন্য চেস্টা করছি এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।
শ্রমিক ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের নিন্দা
ইপিজেডের শ্রমিক নিহতের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন জেলা শ্রমিক ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ও সংঠনের জেষ্ঠ সহসভাপতি মাহবুব আলম। তাঁরা বলেন, আমাদের বহুল প্রত্যাশিত কর্মসংস্থানের প্রকল্প উত্তরা ইপিজেড। অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ইপিজেডটি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। সেই ইপিজেডে প্রশাসনিক দূর্বলতার কারণে শ্রমিকদের দাবিদাবাকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না করে বল প্রয়োগ করে সমাধানের চেষ্টায় শ্রমিক নিহত এবং আহতের ঘটনাটি ঘটেছে। আমরা ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। পাশাপাশি নিহত এবং আহতদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।