স্টাফরিপোর্টার,নীলফামারী॥ উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীতে অবস্থিত বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (বেপজা) পরিচালিত উত্তরা ইপিজেডে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। আজ বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে দেখা যায় ইপিজেডের প্রধান ফটকের সামনে বিশেষ তারাকাটা ব্যারিকেট তৈরী করে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছে।
এদিকে উক্ত ইপিজেডের এভারগ্রীন বিডি কারখানার শ্রমিকদের ২৩ দফা দাবির আন্দোলনকে কেন্দ্র কনে গতকাল মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ইপিজেডের হাবিব ইসলাম (২০) নামের একজন শ্রমিক নিহতের ঘটনার পর ইপিজেডের শিল্পকারখানার কার্যক্রম অঘোষিত ভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
পাশাপাশি আজ বুধবার খবর নিয়ে জানা যায়, নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডের ২৪টি কারখানার সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে উক্ত শ্রমিক নিহতের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) রাতে বেপজা কর্তৃপক্ষ কারখানাগুলোর কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা করে। উত্তরা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আজ বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) পরিস্থিতি দেখে আগামী বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) কারখানাগুলো খুলবে কিনা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ জন্য জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার সহ, জেলা বিএনপি, জেলা জামায়াত, জেলা এনসিপি ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে উত্তরা ইপিজেডের শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘটনা নিরশনে বৈঠকের চেষ্টা করা হচ্ছে। সুত্র মতে আজ বিকাল ৫টার মধ্যেই এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে। বৈঠকে পরিস্থিতির সমাধান হলে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ইপিজেডের সকল কারখানা চালু করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ যে, উত্তরা ইপিজেডে অবস্থিত এভারগ্রীন নামের একটি পরচুলা শিল্পকারখানার ৫১জন শ্রমিক ছাটাই করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ছাঁটাই বন্ধসহ ২৩ দফা দাবিতে চারদিন ধরে আন্দোলন করছিল ওই শিল্পকারখানার শ্রমিকেরা। পাশাপাশি সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে হঠাৎ ওই কোম্পানি বন্ধের নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। এতে মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালে কাজে যোগ দিতে গিয়ে এভারগ্রীন কারখানার শ্রমিকেরা ওই নোটিশ দেখতে পান। এ ঘটনার প্রতিবাদে ইপিজেডের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন শ্রমিকেরা। সকাল সোয়া ৮টার দিকে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সরিয়ে দিতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকদের দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে দাবি শ্রমিকদের। সংঘর্ষে একজন শ্রমিক নিহত হন। নিহত ওই শ্রমিকের হাবিব ইসলাম (২০) ইপিজেডের ইকু ইন্টারন্যাশনাল নিটিং ফ্যাক্টরির শ্রমিক ছিল। আহত হয় দুই নারী সহ ৭ জন। এদের মধ্যে তিনজনকে রংপুর মেডিকেলে ও বাকী ৫জন নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এঘটনায় নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম আর সাঈদ বলেন, মঙ্গলবার বিকালে নিহত শ্রমিকের মরদেহ অনুমতি ছাড়াই হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যায় পরিবারের সদস্য সহ শ্রমিকরা। সেখানে রাতেই ময়না তদন্ত ছাড়া তারা লাশ দাফন করেছেন তারা। নিহত শ্রমিক জেলা সদরের সংগলশী ইউনিয়নের কাজীরহাট মাছিরচাক গ্রামের মো. দুলাল হোসেনের ছেলে।
এদিকে মঙ্গলবার বিকাল ৫টার দিকে নিহত শ্রমিকের মরদেহ নিয়ে নীলফামারী-সৈয়দপুর সড়কের ইপিজেডের সামনে শ্রমিকরা অবরোধ করেছিল। সেখানে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড এলাকা পরিদর্শন করেন এবং নিহতের পরিবারকে শোক-সন্তপ্ত সান্তনা দেয়ার সময় তিনিও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, গতকাল মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আমরা সেনাবাহিনী, বিজিবি, ইপিজেড কর্তৃপক্ষ, এভারগ্রীন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংঘঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছি। শ্রমিকদের ২৩ দফা দাবির বিষয়ে পর্যালোচনা করেছি। শ্রমিকদের যে অভিযোগ ছিল সে সব তদন্তে বেপজা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবে। যৌক্তিক দাবিগুলো ইপিজেড বাস্তবায়ন করবে। আর নিহত হাবিব ইসলামের পরিবারকে আপাতত ২ লাখ টাকা দিয়েছে এভারগ্রীন কর্তৃপক্ষ। আহতদেরও ক্ষতিপুরণ দিবেন তারা। জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ওই ঘটনায় ৭জন শ্রমিক আহত হয়ে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ৩জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। ওই ঘটনায় দুইজন আনছার সদস্য, ৭জন পুলিশ সদস্য, ৪ জন সেনা সদস্য ও একজন বেপজার সদস্য আহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সেখানে ২ প্লাটুন বিজিবি, পুলিশ ও সেনা মোতায়েন রাখা হয়েছে।
এদিকে উত্তরা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার সাংবাদিকদের জানান, শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে আজ বিকালে আলোচনা মাধ্যমে আগামীকাল বৃহস্পতিবার(৪ সেপ্টেম্বর( ইপিজেডের সকল শিল্পকারখানা চালু করার চেস্টা করা হচ্ছে।
উত্তরা ইপিজেডের ঘটনায় রাজনৈতিক দল সহ বিভিন্ন সংগঠনের শোক প্রকাশ:
এদিকে উত্তরা ইপিজেডের শ্রমিক অসন্তোসের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে এক শ্রমিক নিহতের ঘটনায় বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনসিপি সহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন শোক প্রকাশ করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার(২ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৭টার দিকে ৭ দফা দাবি নিয়ে নীলফামারী জেলা শহরের প্রগতিপাড়াস্থ (আল হেলাল একাডেমির সামনে) এনসিপি জেলা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির উত্তরাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আবু সাঈদ লিওন।
এনসিপির পক্ষে ৭ দফা দাবিগুলি হচ্ছে- উত্তরা ইপিজেডের শ্রমিকদের সকল ন্যায্য দাবি বাস্তবায়ন, কর্মী বা শ্রমিক ছাটাইয়ের ক্ষেত্রে কারখানাগুলির সুনির্দিষ্ট নিতিমালা, নিহত শ্রমিক হাবিব ইসলামের পরিবারকে তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ, আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করে তাদের পূর্ণবাসন, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের ওপর মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দেয়া যাবে না, গুলি নিদের্শেনাদাতাকে সনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা ও মানুষের প্রাণনাশ ঘটবে এমন কোনো মারণাস্ত্র নীলফামারী জেলার কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার যেন করতে পারবে না।
এসময় আবু সাঈদ লিওন অভিযোগ তুলে বলেন, আমরা জানতে পেরেছি এখন একটি চক্র নীলফামারী উত্তরা ইপিজেড বন্ধের পায়তারায় চক্রান্ত করছে। আমরা চাই জেলাবাসী ইপিজেড রক্ষার্থে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।