আর্কাইভ  সোমবার ● ২০ অক্টোবর ২০২৫ ● ৫ কার্তিক ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ২০ অক্টোবর ২০২৫
জামায়াতের পিআর আন্দোলন রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়: নাহিদ

জামায়াতের পিআর আন্দোলন রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়: নাহিদ

দায়সাড়া সাক্ষরে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ আছে

রংপুরে সারজিস
দায়সাড়া সাক্ষরে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ আছে

জামায়াতের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক স্ট্যাটাস নাহিদের

জামায়াতের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক স্ট্যাটাস নাহিদের

নির্বাচন কমিশনের রিমোট অন্য কারও হাতে: হাসনাত

নির্বাচন কমিশনের রিমোট অন্য কারও হাতে: হাসনাত

সীমান্তে দুই দেশের মানুষের মিলন মেলা

রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, রাত ০৯:১৮

Advertisement

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: লালমনিরহাট সীমান্তে দু'দেশের মানুষের মিলন মেলা বসেছে। জারিধরলার শ্যামা মন্দিরের পুজোয় পুরোহিত বাংলাদেশের আর পূজারী ভারতের হয়ে থাকে। শ্যামা পুজা বা বুড়ির মেলা উপলক্ষে আজ রবিবার সীমান্ত ছিল একেবারে উন্মুক্ত। এই সীমান্তে ২০০৮ সালের পর এই প্রথম দুই দেশের মানুষ বিনা পাসপোর্ট ও ভিসায় অবাদে মেলায় অংশ নিয়েছে। 
 
 লালমনিরহাটের দুর্গাপুর ও মোগলহাট সীমান্তে ধরলা নদীর পাড়ে ৯২৭ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছে রবিবার (১৯ অক্টোবর) দিনভর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত মিলন মেলায় দেখা হয় তাদের।
 
একে অপরকে দেখার পর আর কিছু বলার শক্তি ছিল না, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে  কেবল কান্না, আর কান্না। প্রায় দশ- পনের  মিনিট ধরে চোখের জল অঝরে ঝরেছে। চোখের জল বলে দেয় কতটা প্রশান্তি ছিল এই মিলনে।
 
মেলা হতে ফিরে আসা যুবক আসলাম (৪৫) জানান, মেলায় দেখলাম দুই বোন একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। তখন  সীমান্তের মেলায় একমুহূর্তের যেন  থমকে গিয়েছিল। প্রায় দুই যুগ পর আবার দেখা দুই বোনের।
 
মেলা উপলক্ষে বাংলাদেশের শুসিলা রানী (৬০) আর ভারত হতে নিয়তি রানী (৫৮) এসেছে। এই মেলা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দুই সপ্তাহ ধরে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা করেছে প্রভাবশালী মহল।
 
বড় বোন শুসিলা রানী এনেছিলেন মিষ্টি, ইলিশ মাছ আর টাঙ্গাইলের শাড়ি। ছোট বোন নিয়তি রানী এনেছিলেন মিষ্টি, মসলা ও ভারতের প্রিন্ট  শাড়ি এবং জামদানী শাড়ি। উপহার বিনিময়ের সময়ও দুই বোনের চোখে অশ্রু ঝরেছে অনর্গল।
“প্রায় ২৪  বছর থাকি বোনের সাথে মোর দেখা স্বাক্ষাত হয় না। ২০০৯ সালের পর মোবাইল ফোনে কথা হয়।  তাতে মন ভরে না। ২০২১ সালের পর ভিডিও কলে কথা হয়। ভিডিও কলো কথা বলার সময়  বুকটা ফেটে যায়। বুড়ির মেলাত আসি বোনের দেখা পেয়া মনটা জুড়ি গ্যালো। দেখা হবে আগে থাকি কথা। ফোনে কথা হইছিল।
বাংলাদেশের আদিতমারী উপজেলার দেওডোবা গ্রামের শুসিলা রানী বাড়ি। অপরদিকে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার গিদালদহ গ্রামের নিয়তি রানী বাড়ি। তিনি জানান,  প্রায় ৩৫  বছর আগে  এক রাতে ভারতে চলি আসি। আসার সময়  মা-বাপ রেখে এসে ছিলাম। বাবা- মা মরি গ্যাইছে দেখতে পাইনি। এখন বাংলাদেশে শুধু  দিদি বেঁচে আছে। এমন হাজার পরিবারের গল্প বুনেছে এই মেলা। প্রতি বছরই ধরলা নদীপাড়ে সীমান্তের কোলঘেষে ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার দড়িবাস এলাকায় শ্রীশ্রী মা বৃদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজা উপলক্ষে বসে এই সীমান্ত মেলা বসে। স্বাধীনতার আগে হতে  পূজা ও মিলন মেলা একসাথে চলছে এখানে। ১৯৯২ সালে ভারতে মাওবাদী গেরিলাদের উত্থান ঘটলে মেলায় কড়াকড়ি আরপ হয়। সেই সময় মোগলহাট ইমিগ্রেশন রুট ও রেল রুটটি ভারত সরকার ক্লোজ করে দেয়। তখন হতে মেলায় ভারতীয়দের জন্য উম্মুক্ত শুধু ছিল। মেলাটি ভারতীয় ভূ-খণ্ডে হলেও অনেক স্থানে  কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে আসতে হয়। সেই  সময় হতে বিজিবি- বিএসএফ কড়াকড়ির কারণে বাংলাদেশ হতে প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এবছর পুনরায় উন্মুক্ত  হয়ে গেছে। 
 
একটি সূত্র বলছে, এবছর এই পূজার বিশেষত্ব—মন্দিরের পুরোহিত আসেন বাংলাদেশ থেকে আর আর পূজারী ভারতের। দুই দেশের মানুষ একসাথে পূজা দেন, একসাথে প্রসাদ খান, আর একদিনের জন্য হলেও ভুলে যান সীমান্ত রেখার বিভাজন।
 
বাংলাদেশের পুরোহিত বিকাশ চন্দ্র চক্রবর্তী জানান, “প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত আসেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূজা হয়। এই মন্দির প্রাঙ্গন হয়ে দুই দেশের ভক্তদের মিলন মেলা। অনেকে আসেন ভক্ত হিসেবে মন্দিরে পূজা করতে আবার অনেকে আসেন দর্শানর্থী হিসেবে।’
 
ভারতের পূজারী জ্যোতিষ চন্দ্র রায় বলেন, “পুরোহিত বাংলাদেশে, পূজারী ভারতে—এটা সম্প্রীতির প্রতীক। দুই দেশের ভক্তরা মিলেই এই মন্দির চালায়, আর্থিক সহযোগিতাও দু’দেশের মানুষই করে।
 
রবিবার দিনভর পূজা উপলক্ষ্যে মিলন মেলায় ২০-২৫  হাজারের বেশি ভক্ত ও দর্শথনার্থী সমবেতন হন। বিকাল চারটা থেকে দর্শনার্থীরা বাড়িতে ফিরে যেতে শুরু করেন। কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি মেলায়। মেলায় বিপুলসংখ্যক বিএসএফ কে টহল দিতে দেখা গেছে।  মেলা ঘিরে দুই দেশেরই ভক্তরা আসেন নানা জায়গা থেকে। মন্দির প্রাঙ্গণে বসে খাবার, খেলনা, শাড়ি, গয়নার দোকান।
 
সূর্যোদয়ের সঙ্গে শুরু হয় পূজা, সূর্যাস্তের আগে শেষ হয় সব আয়োজন। নিরাপত্তায় সতর্ক থাকে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী—বিজিবি ও বিএসএফ।
 
মেলায় শুধু লালমনিরহাট নয়, রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, নীলফামারী, ঠাকুর গাঁও, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রাম সহ দেশের নানা জেলা হতে মানুষ এসেছে। শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এসে তা কিন্তু নয়। এসেছে মুসলিম, খৃষ্টান সহ নানা সম্প্রদায়ের মানুষ।  কারণ দুই দুই বার দেশ ভাগ হয়েছে একবার ১৯৪৭ সালে আরেকবার ১৯৭১ সালে। তখন সকল সম্প্রদায়ের পরিবার গুলো ভাগ হয়ে গিয়ে ছিল।  সেই  স্বজনরা প্রযুক্তির কল্যাণে মেলায় একত্রিত হতে পারে।  এখানে এসে আত্মীয়দের বুকে জড়িয়ে ধরেছে।  সীমান্তের এই মেলায় কাঁদে সবাই, কিন্তু সেই কান্নায় থাকে আনন্দের সুর। এটা শুধু আবেগ নয়, এটা সীমান্ত পেরোনো প্রেমের এক অফুরন্ত চিত্র।”
 
ভারতের কোচবিহার জেলার ভেটাগুড়ি থেকে আসা দর্শনার্থী ধীরেন্দ্র নাথ বর্মণ জানান,’ বাংলাদেশে অনেকে আত্মীয় স্বজন মেলায় এসেছিলেন। অনেকের সাথে দেখা হয়েছে। আমাকে জড়িয়ে অনেকে কেঁদেছেন, আমিও কেঁদেছি।’ মেলা প্রকাশ্য হলেও বাংলাদেশের স্থানীয়  প্রশাসনের কেউ মেলা সম্পর্কে কোন কথা বলেনি। তবে একটি সূত্র বলছে ঐতিহাসিক পটভূমির কারণে সীমান্ত মেলা হয়েছে। 

মন্তব্য করুন


Link copied