আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ● ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
 
 width=
 
 
 width=
 
শিরোনাম: সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ       এসএসসির সময়সূচি প্রকাশ, পরীক্ষা শুরু ১০ এপ্রিল       বড়পুকুরিয়া খনির ১৪১৪ ফেইস থেকে উত্তোলিত কয়লা ৪.৮১ লক্ষ টন       রংপুরে অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনীর বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ       রংপুর জেলা ট্রাক মালিক সমিতির নব নির্বাচিত কমিটির শপথ গ্রহন      

 

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বশান্ত কয়েক হাজার পরিবার

বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, দুপুর ০৩:৫৮

রবিউল এহ্সান রিপন, ঠাকুরগাঁও : গ্রামের সবাই খায়রুন সুন্দরী নামে ডাকে উম্মে হুমাইরা সাইমাকে। এখন চার বছর পূর্ণ হয়নি তার। বয়সে পূর্ণ না হলেও স্বজন হারানোর অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ সাইমা। বাবা শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে মারা গেছেন। কিছুদিন পরে অন্যত্র বিয়ে করেছেন তার মা। বাবা, মা হারিয়ে এখন দাদির কাছে মানুষ হচ্ছে সাইমা।

ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ গ্রামে দাদা শাহার আলী ও দাদী সাহেরা খাতুনের সাথে বেড়ে উঠছে সাইমা। বাবা শফিকুল ইসলাম পেশায় ছিলেন অটো মেকানিক। সে আয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলতো পরিবারের ভরণপোষণ। পরে অর্থের লোভে অনলাইন জুয়ার (ক্যাসিনো) ফাঁদে পড়ে হারিয়েছেন সকল পুঁজি। সর্বস্ব হারিয়ে করেছেন পাঁচ লক্ষাধিক টাকা ঋণ। ঋণের বোঝা সইতে না পেরে নিজের শরীরে পেট্রোল দিয়ে আগুন লাগিয়ে মারা গেছেন তিনি।

ঠাকুরগাঁওয়ে এভাবেই অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন কয়েক হাজার পরিবার। অর্থের লোভে পড়ে আসক্ত হচ্ছেন শিক্ষক, চিকিৎসক, দোকানি সহ শিক্ষার্থী ও তরুণেরা। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারাতে বসেছেন তাঁদের অনেকে। এতে বেড়েছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ। এ সুযোগে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন অনলাইন জুয়া চক্রের ডিলারেরা। শত টাকার মালিক থেকে হয়েছেন লাখ লাখ টাকার মালিক। চক্রের সাথে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় এনে তরুণ ও যুব সমাজকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার দাবি এলাকাবাসীর।

সরেজমিনে মঙ্গলবার ওইসব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অনলাইন জুয়ার ডিলারদের লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়ে সর্বস্ব হারাতে বসেছেন সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ, বোর্ড অফিস, সোনাহার, সেনপাড়া সহ কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষেরা। প্রত্যেকটি পরিবার থেকে এ খেলায় যুক্ত হয়ে পথে বসেছেন অনেক পরিবার। গ্রামগুলো যেন অনলাইন জুয়ার রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। একাধিক ডিলারদের তত্বাবধানে এ নেশায় আকৃষ্ট হয়েছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। যার ফলে পারিবারিক ভাবে অশান্তি, বিবাহ বিচ্ছেদ, কলহ সহ ও পড়াশোনা বিমুখ হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। অনলাইন জুয়ার ভয়াল এ গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সাধারণ মানুষ।

তবে অনলাইন জুয়া খেলে সর্বশান্ত হওয়ারা জানান, একদিকে অনলাইন জুয়ার নেশায় সাধারণ মানুষ সর্বশান্ত হলেও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন জুয়া চক্রের ডিলাররা। আউলিয়াপুর ইউনিয়নের সেনপাড়া গ্রামের হেমন্ত সেন। দর্জি বিজ্ঞানের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। কয়েক বছর আগেও পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতেন তিনি। নিয়তির ঘুরপাকে অনলাইন জুয়ার ডিলার হয়ে পেয়েছেন আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ। দুই লাখ টাকার মোবাইল সেট ও দামী ল্যাপটপ, চলাফেরা করেন চার লাখ টাকার মোটরসাইকেলে আর গ্রামে করেছেন দৃষ্টি জুড়ানো ফ্ল্যাট বাড়ি। কিছুদিন আগেও যাদের নুন আন্তে পান্তা ফুরাতো তাদের এমন উত্থানে হতভম্ব এলাকার মানুষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনলাইন জুয়া খেলার সাথে জরিত একজন বলেন, অনলাইনে সহজেই এখন এই খেলাগুলো খেলা যায়। জুয়ার ডিলারের সাথে যোগাযোগ করে খেলায় একাউন্ট করতে হয়। পরে ডিলারের মাধ্যমেই টাকা তোলা যায় ও খেলায় টাকা লাগানো হয়। অনলাইন জুয়া খেলার অনেকগুলো সাইট আছে। একাউন্ট করে বিকাশ, নগদ এর মাধ্যমে টাকা নিয়ে খেলায় টাকা লাগাতে হয়। লাভ হলে আবার বিকাশ, নগদ এজেন্ট এর মাধ্যমে টাকা তুলতে হয়। তবে এ খেলায় যারা ডিলার তারাই লাভবান হয়। সাধারণ যারা খেলে তারা প্রথমে লাভের লোভে পরে সর্বশান্ত হয়।

এই এলাকায় যারা ডিলার রয়েছেন তারা এখন সকলেই লাখোপতি। তারা আইনের ধরাছোয়ার বাহিরে। এই এলাকায় অনেকগুলো ডিলার রয়েছে অনলাইন জুয়ার। যেমন, কচুবাড়ি এলাকার তাপস চন্দ্র রায়, সাশলা মাদ্রাসা এলাকার বাদশা, মামুন, সোহেল, কচুবাড়ি দাঙ্গা পাড়া এলাকার বিকাশ রায়, রাসেল, শামিম, রোমানী সহ প্রায় শতাধিক। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি রেকর্ড রুমের বড়বাবু খ্যাত প্রধান উচ্চমান সহকারী সাইফুর রহমান এই খেলার সাথে জরিত।

জুয়া খেলে ও ডিলার ছিল এমন আরেকজন জানান, ডিলারদের কাছে অনলাইন ব্যাংকিং এর এজেন্ট সিম থাকে। সেই সিম থেকে টাকা লেনদেন হয়। প্রতিদিন এসব সিমে লাখ লাখ টাকা লেনদেন হয়। অনলাইন ব্যাকিং এর যেসকল ডিলার রয়েছে তারা এসব কিছু জানে। তাদের কাছে এসব এজেন্ট সিম ভাড়া হিসেবে নিয়ে চালায় জুয়ার ডিলারেরা। টাকা লেনদেন হলে ডিলারের লাভ হয়। তবে সাধারণ জুয়া খেলোয়ার লাভ করতে পারে না। প্রথমে খেলায় লাভের লোভ দেখানো হয়। সেই লোভে পরেই জুয়া খেলোয়ারেরা ঝাপিয়ে পড়ে। আর মোবাইল দিয়ে খেলতে হয় তাই যেখানে ইচ্ছা খেলা যায়।

সদর উপজেলা বোর্ড অফিস এলাকার নুর ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকার কম বেশি অনেকেই এই খেলার সাথে জরিত। সন্ধ্যার পরে যেখানে সেখানে কয়েকজন বসে এই জুয়া খেলার আসর বসায়। তবে তারা মোবাইলে খেলে সেজন্য কেও তাদের ধরতে পারে না। এই এলাকার অনেকেই আজ সর্বশান্ত হয়ে গিয়েছে জুয়া খেলে। প্রশাসনও তেমন প্রদক্ষেপ না নেওয়ায় দিন দিন জুয়া খেলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর যারা জুয়া খেলার ডিলার রয়েছে তারা তো হঠাৎ আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতই অবস্থা। তবে দ্রæত ব্যবস্থা না নিলে মানুষ আরো বেশি ধংস্ব হয়ে যাবে।

গোপনসূত্র বলছে, অনলাইন জুয়া চক্রের ডিলারদের সাথে যোগসাজশ রয়েছে অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিং এর ডিস্ট্রিবিউটর ও সেলস অফিসারদের। দোকান না থেকেও এজেন্ট সীম দেওয়া, দৈনিক ও মাসিক ভাড়া নেওয়া ও ডিলারদের কাছে মাসোহারা নিয়ে থাকেন তারা।

ওই এলাকার বিকাশ, নগদ, ফেক্সিলোড ব্যবসায়ি রশিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের এখানে বড় ব্যবসা না থাকায় তেমন লেনদেন হয় না। তবে যে এজেন্ট সিমগুলো অনলাইন জুয়ায় ব্যবহার হয় সেগুলোতে দিনে লাখ টাকা লেনদেন হয়। তাই এই বিকাশ, নগদ ডিলারেরা এজেন্ট সিমগুলো অনলাইন জুয়ার ডিলারদের না দিলে তারা সেভাবে লেনদেন করে খেলা পরিচালনা করতে পারবে না।

অনলাইন জুয়ার ডিলার অভিযোগে হেমন্ত সেনের খোঁজে তার বাড়িতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। তার স্ত্রী মিনাক্ষী সেনের কাছে মোবাইল নম্বর চাইতে গেলে রেগে ফুপে ফুসে উঠেন তিনি। প্রতিবেদকের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ও প্রতিবেদন হলে মামলারও হুমকি দেন মিনাক্ষী সেন।

এলাকার অনলাইন জুয়া চক্রের অন্যতম ডিলার হেমন্ত সেন। তার মাধ্যমেই বিস্তার হয়েছে এ সর্বনাশী নেশা। নগদ ও বিকাশের এজেন্ট সীম ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকার মালিক হেমন্ত। তবে আগে অনলাইন জুয়ার সাথে যুক্ত থাকলেও এখন অনলাইন খেলেন না বলে দাবি হেমন্তের মা যাত্রী রাণী সেনের।

অনলাইন জুয়ায় মোবাইল ব্যাংকিং এর সিম ব্যবহার হয় এমন অভিযোগে অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিং এর জেলার ডিস্ট্রিবিউটর ও কর্তৃপক্ষের সাথে কয়েক দফায় কথা বলার চেষ্টা করলেও প্রধান দপ্তরের অযুহাতে কথা বলতে রাজি হননি তারা।

ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম পিপিএম বলেন, মানুষকে সর্বগ্রাস করে ফেলে জুয়া। অনলাইন জুয়ার তেমন কোন আইন নেই। সাধারণ জুয়ার আইনে তাদের আটক করতে হয়। সেজন্য অপরাধ অনেক বড় হলেও সহজেই পার পেয়ে যায় অপরাধিরা। এছাড়াও অনলাইন জুয়া খেলা হয় মোবাইলে। সেজন্য সহজেই জুয়ারুদের ধরাও যায় না। এ চক্রের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানালেন নবাগত পুলিশ সুপার।

মন্তব্য করুন


 

Link copied