লালমনিরহাট প্রতিনিধি: ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও’—এভাবেই চলছে লালমনিরহাট কালীগঞ্জের চরাঞ্চলের জীবনযাত্রা ও স্বাস্থ্যসেবার চরম সংকট।
বুধবার ভোরের এই হৃদয়বিদারক চিত্রটি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তিস্তা চর এলাকার। অসুস্থ মাকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে কাঁধে তুলে নিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত বালুচর আর ভাঙা পথে ছুটে চলছেন দুই যুবক। মধ্যরাতে মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভোরের আলো ফুটতেই শুরু হয় তাদের এই জীবন বাঁচানোর লড়াই। রাস্তার অভাবে গাড়ি তো দূরে থাক, এমনকি হেঁটে চলাও যেখানে দুরূহ, সেখানে একমাত্র ভরসা নিজেদের সন্তানের কাঁধ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিস্তা চরের বাসিন্দা এক বৃদ্ধা মধ্যরাতে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চরাঞ্চলে দ্রুত চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এবং হাসপাতাল বহুদূরে হওয়ায় দুই ছেলে নিরুপায় হয়ে নিজেদের কাঁধকেই অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে নেন। বালুচর উপেক্ষা করে হাসপাতাল পৌঁছানোর জন্য ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই তারা প্রায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ মাকে কাঁধে করে পাড়ি দিতে শুরু করেন। নদী আর বালুচরের এই রুক্ষ পথে সন্তানেরা মায়ের জীবন বাঁচাতে যে রুদ্ধশ্বাস দৌড় শুরু করেন, তা মুহূর্তে স্থানীয়দের চোখে এনেছে জল।
এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা একটি প্রবাদেই বাঁধা পড়ে আছে—”বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও”। তিস্তা নদীর গতিপথের পরিবর্তন এবং পর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে চরাঞ্চলের মানুষের কাছে জীবনযাত্রা এক কঠিন পরীক্ষা। বর্ষাকালে নদী ফুলে ফেঁপে উঠলে নৌকা ছাড়া যাতায়াতের উপায় থাকে না। আবার শুকনো মৌসুমে তিস্তার বুকে ধু-ধু বালুচর জেগে ওঠায় নৌকা চলে না, সড়ক না থাকায় গাড়িও পৌঁছায় না। ফলে চরের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বাধ্য হন। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিতে যাওয়াটা যেন তাই আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
চরাঞ্চলের একাধিক বাসিন্দা জানান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল এই এলাকা থেকে বহু দূরে। শুকনো ও বর্ষা, দুই মৌসুমেই যোগাযোগ ব্যবস্থা চরম খারাপ থাকায় দ্রুত রোগী পরিবহন অসম্ভব হয়ে পড়ে। বর্ষায় ভাঙন আর বন্যায় যেমন সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি শুকনায় বালুচর আর যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা তিস্তার মানুষকে পিছিয়ে রেখেছে। সড়ক, সেতু বা কালভার্টের মতো জরুরি অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাবে এই এলাকার কয়েক হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
চরাঞ্চলের মানুষের জন্য আধুনিক যোগাযোগ ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তাদের মতে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়িত হলে নদীভাঙন ও যোগাযোগ সংকটের সমাধান হয়ে চরাঞ্চলের এই দুর্ভোগের চিত্র পাল্টানো সম্ভব।