নিউজ ডেস্ক: রংপুরের কাউনিয়া মীরবাগ ডিগ্রি কলেজে পরীক্ষা চলাকালীন শিক্ষকের কাছে মোবাইল, রুমে ও টয়লেটে নকলের মহোৎসবের ভিডিও করায় ৫ সাংবাদিককে মারধর ও ক্যামেরা ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে ওই কলেজ অধ্যক্ষ ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
বৃহস্পতিবার (৮ মে) দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রংপুর সিটি প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সমকাল ব্যুরো প্রধান স্বপন চৌধুরী। এ ঘটনায় গুরুতর আহত ৩ জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত সাংবাদিকরা হলেন, বিজয় টিভির ব্যুরো প্রধান হামিদুল রহমান ও ভিডিও সাংবাদিক শাহীন আলম সাবু, স্থানীয় অনলাইন প্লাস টিভির রিপোর্টার মেহেদী হাসান, ভিডিও সাংবাদিক মশিউর রহমান ও আল আমিন।
এ বিষয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিজয় টিভির রংপুরের ভিডিও সাংবাদিক শাহীন আলম সাবু বলেন, মীরবাগ ডিগ্রি কলেজে টাকার বিনিময়ে নকল হচ্ছে এই ধরনের তথ্যের ভিত্তিতে প্রিন্সিপাল স্যারকে অবহিত করে আমরা সেখানে গিয়ে দেখি রুমে রুমে শিক্ষক ও পরিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল, টয়লেট এবং অন্যান্য রুমে ছেড়া বই ও নকলের ছড়াছড়ি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেগুলো ভিডিও ধারণ করি। তখন বিকেল সোয়া ৩ টা। তখনও কেন্দ্রের ট্যাগ অফিসার কাউনিয়া উপজেলা ভারপ্রাপ্ত মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আরিফ হোসেন কেন্দ্রে ছিলেন না। আমাদের ফোন পেয়ে ৪৫ মিনিট পর তিনি আসেন।
‘এরপর আমরা ট্যাগ অফিসারের পেছনে পেছনে রুমে গিয়ে দেখি শিক্ষক ও পরিক্ষার্থীদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। তৎক্ষণাৎ সেগুলো আমরা ভিডিও করি। এসময় এক শিক্ষকের হোয়াটস আ্যাপে বের হয়ে আসে এক ছাত্র তাকে লিখেছেন “স্যার আমরা খাতা জমা দিয়ে বের হলাম”। পরে ট্যাগ অফিসারকে নিয়ে আমরা বাথরুমে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি টয়লেটে ছেড়া অসংখ্য বই ও নকল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে।’
ভিডিও সাংবাদিক সাবু আরও বলেন, এরপর ট্যাগ অফিসার আমাদেরকে প্রিন্সিপাল জয়নাল আবেদীনের রুমে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে ট্যাগ অফিসার প্রিন্সিপালকে নকলের বিষয়ে শাসান। আমরা প্রিন্সিপালের বক্তব্য নিতে গেলে তিনি আমাদের উপর চড়াও হন এবং পরবর্তিতে মোবাইল ফোনে ছাত্রদের উস্কে দিয়ে আমাদের আমাদের ওপর হামলা করেন এবং প্রিন্সিপালের রুম থেকে বের করে নিয়ে অন্য একটি রুমে আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এসময় হামলাকারীরা আমাকে ভিডিও ডিলিট করার জন্য চাপ দেন। ভিডিও মুছে না ফেলায় তারা ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে। বিষয়টি পুলিশকে জানালেও তারা ঘটনাস্থলে এসে আমাদের উদ্ধার করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় আবারও প্রিন্সিপালের নেতৃত্বে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে হামলা করে। এসময় পুলিশ নিরব ভূমিকা পালন করে।
‘পরে আবারও অবরুদ্ধ করে রেখে প্রিন্সিপাল একটি স্ট্যাটাম্পে আমরা যেন তাদের বিরুদ্ধে নিউজ না করি এই মর্মে মুচলেকা পত্রে আমাদের সই দিতে বাধ্য করে। পরে রংপুর থেকে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এসে সন্ধ্যায় আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করান’ বলেন তিনি।
বিজয় টিভির ব্যুরো প্রধান হামিদুল রহমান জানান, ওই সেন্টারে টাকার বিনিময়ে নকল হচ্ছে কয়েকজনের মাধ্যমে জানতে পেরে আমরা সেখানে যাই। যাওয়ার আগে ওসি ও ইউএনও মহোদয়কে অবহিত করি। সেই সাথে কেন্দ্র সচিবের অনুমতি নিয়ে ট্যাগ অফিসারের সাথে পরিক্ষার কক্ষে প্রবেশ করে নকলের সত্যতা পাই। কলেজের প্রিন্সিপাল ও অভিযুক্ত কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়ে আমাদের কয়েকদফা মারধর করে এবং ক্যামেরা ভাঙচুর করে। শুধু তাই নয়, মারধরের পাশাপাশি নকলের কেন নিউজ করতে এসেছি এজন্য তারা কানধরে উঠবস করায় আমাদের।
রংপুর সিটি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির মানিক বলেন, আমরা অবরুদ্ধ ও আহত অবস্থায় সহকর্মীদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। প্রিন্সিপাল নকলের ঠিকাদারি নিয়ে ওই কেন্দ্রে ব্যপক নকল করাচ্ছেন। নকল বিষয়ে চুক্তি নেয়া প্রিন্সিপালের একধরণে ব্যবসা। এগুলো তুহিন নামে এক শিক্ষদের মাধ্যমে করান তিনি। সাংবাদিকরা সেই ছবি তুলতে গেলে তাদের ওপর হামলা করে অবরুদ্ধ করে রাখে। শুধু তাই নয়, তারা মুচলেকা নেওয়ার সাহস দেখায়। সহকর্মীরা একটু সুস্থবোধ করলে আমরা মামলা করব। এ ঘটনায় অভিযুক্ত প্রিন্সিপাল ও অভিযুক্ত অন্যান্য শিক্ষক, ট্যাগ অফিসারকে অপসারণ এবং হামলাকারীদের গ্রেফতার করা না হলে কঠোর আন্দোলনে যাব আমরা।
রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সরকার মাজহারুল মান্নান বলেন, রংপুরে বিভিন্ন কেন্দ্রে নকল চলছে দেদারছে। এর আগেও মিঠাপুকুরে একজন অধ্যক্ষ আমাদের সময়ের প্রতিনিধিকে হাটু ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এখন মীরবাগ কলেজের অধ্যক্ষের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও ক্যামেরা ভাঙচুর ও মুচলেকা নেয়ার ঘটনা ঘটলো। সেখানে পুলিশ এবং ট্যাগ অফিসারের নিরব ভূমিকাকে খুবই খারাপভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি আমরা। জড়িত প্রিন্সিপালসহ ট্যাগ অফিসারের অপসারণ চাই আমরা। একই সাথে হামলাকারীদের গ্রেফতার চাই। আমরা মনে করছি সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্ট হিসেবে প্রিন্সিপাল, ট্যাগ অফিসাররা টাকার বিনিময়ে নকলে সহযোগিতা করছে। আমাদের দাবি মানা না হলে আমরা পুলিশ সুপার, ডিআইজি কার্যালয়ে লাগাতর অবস্থান কর্মসূচিতে যাব।
রংপুর সম্মিলিত সাংবাদিক সমাজের সদস্য সচিব লিয়াকত আলী বাদল বলেন, সেখানে ট্যাগ অফিসারও নকলের সাথে সরাসরি জড়িত। তা না হলে তিনি কেন্দ্রে কেন থাকলেন না। তার উপস্থিতিতে ভিডিও করা হলো। অথচ তিনি প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সাংবাদিকদের ওপর হামলার সুযোগ করে দিলেন। দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা না হলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।
এ ব্যপারে কয়েকদফা ট্যাগ অফিসার ও কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, কেন্দ্রে নকল এবং সাংবাদিকের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। প্রিন্সিপাল, ট্যাগ অফিসারসহ ঘটনার সাথে জড়িত কেউই রক্ষা পাবে না।
রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আমিনুল ইসলাম জানান, নকলকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকদের মারধরের ঘটনায় পুলিশের কোনো গাফিলতি থাকলে আমরা খতিয়ে দেখে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো। সেই সাথে সাংবাদিকরা মামলা করলে আমরা যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেব।