নিউজ ডেস্ক: চোখ আমাদের শরীরের সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটি। আজকের ডিজিটাল যুগে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি, তাই চোখের যত্ন নেওয়া আগের চেয়ে আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, অফিসের দীর্ঘ সময়ের কাজ কিংবা নেটফ্লিক্সে সিরিজ দেখা – সবকিছুতেই চোখের উপর চাপ পড়ে। কিন্তু আমরা ক’জনই বা চোখের যত্ন সম্পর্কে সচেতন?
যেভাবে আমরা ত্বকের বা শরীরের যত্ন নিই, তেমনভাবেই আমাদের চোখের জন্যও কিছু রুটিন থাকা দরকার। পরিষ্কার দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখা এবং দীর্ঘমেয়াদে চোখের নানা রোগ যেমন শুষ্ক চোখ, চোখে ঝাপসা দেখা, ছানি পড়া কিংবা গ্লুকোমা প্রতিরোধে নিয়মিত চোখের যত্ন অপরিহার্য। চলুন জেনে নিই চোখ ভালো রাখার কিছু কার্যকর উপায়-
১. ২০-২০-২০ নিয়ম মেনে চলুন
আজকাল সবচেয়ে সাধারণ চোখের সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনে চোখ রাখা। অনেকক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের পেশিগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে সহজ একটি নিয়ম অনুসরণ করতে পারেন। তাই প্রতি ২০ মিনিট পর, ২০ সেকেন্ডের জন্য, ২০ ফুট দূরে তাকান। এই পদ্ধতিতে চোখের উপর চাপ কমবে এবং চোখ বিশ্রাম পায়।
এছাড়া, স্ক্রিন ব্যবহারের সময় বেশি করে চোখের পলক ফেলা জরুরি, কারণ তখন আমরা স্বাভাবিকের তুলনায় কম পলক ফেলি, যা চোখ শুকিয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
২. সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন
আপনার খাদ্যাভ্যাস সরাসরি আপনার চোখের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন-এ, সি, ই, জিঙ্ক এবং লুটেইন চোখের জন্য খুবই উপকারী। তাই খাদ্যতালিকায় যুক্ত করুন গাজর, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলুর মতো বিটা-ক্যারোটিন ও ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ সবজি। সবুজ শাকসবজির মধ্যে যোগ করতে পারেন পালং শাক, যা লুটেইন ও জিয়াজ্যানথিনে ভরপুর। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বাদাম ও বীজ খেতে পারেন, যেমন কাঠবাদাম ও সূর্যমুখীর বীজ ইত্যাদি যা ভিটামিন-ই এর ভালো উৎস। এই খাবারগুলো খেলে বয়সজনিত ছানি ও চোখ শুষ্ক হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়।
৩. সূর্যের রশ্মি থেকে চোখকে রক্ষা করুন
ত্বকের মতো চোখও সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘ সময় এই রশ্মির সংস্পর্শে থাকলে ছানি বা ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের মতো সমস্যা হতে পারে। তাই বাইরে বের হলে ইউভিএ ও ইউভিবি রশ্মি রোধ করে এমন সানগ্লাস ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে সানগ্লাসের পাশাপাশি চওড়া কিনারাওয়ালা টুপি পরুন
৪. নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করান
আপনার দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক মনে হলেও প্রতি এক বা দুই বছর অন্তর চোখের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা করানো উচিত। এতে করে মাইওপিয়া (নজর কম দেখা), হাইপারমেট্রোপিয়া, অ্যাস্টিগম্যাটিজম, ছানি, গ্লুকোমা, ডায়াবেটিসজনিত চোখের সমস্যা সময় থাকতেই ধরা পড়বে।
৫. স্ক্রিন টাইম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করুন
আমরা স্ক্রিন ছাড়া জীবন কল্পনাও করতে পারি না, কিন্তু কিছু অভ্যাস বদলালে চোখের ক্ষতি কমানো সম্ভব। যেমন-
অ্যান্টি-গ্লেয়ার স্ক্রিন প্রটেক্টর ব্যবহার করুন।
স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা ও কনট্রাস্ট ঠিকমতো সামঞ্জস্য করুন।
মনিটরটি চোখের সমান্তরালে এবং এক হাত দূরত্বে রাখুন।
রাতে ঘুমানোর আগে স্ক্রিন ব্যবহারে বিরতি দিন।
আরও ভালো হয় যদি স্ক্রিন টাইমে ব্লু-লাইট ব্লকিং চশমা ব্যবহার করেন।
৬. প্রচুর পানি পান করুন
চোখ শুষ্ক হওয়ার একটি বড় কারণ ডিহাইড্রেশন। প্রতিদিন যথেষ্ট পানি পান করলে চোখের ভেতরের শ্লেষ্মা ঝিল্লিগুলো সজীব থাকে। অতিরিক্ত ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল পান করলে পানিশূন্যতা বাড়ে, তাই এগুলো এড়িয়ে চলুন। প্রচুর পানি পানের পরেও চোখ শুকনো হয়ে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে কৃত্রিম অশ্রু ব্যবহার করতে পারেন।
৭. চোখে হাত দিয়ে ঘষা থেকে বিরত থাকুন
ঘুমঘুম ভাব বা চোখে অস্বস্তি লাগলে আমরা প্রায়ই চোখে হাত ঘষে ফেলি। কিন্তু এতে চোখের রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে,ডার্ক সার্কেল তৈরি হয়, হাতের জীবাণু চোখে গিয়ে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তাই চোখ চুলকালে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন অথবা উপযুক্ত আইড্রপ ব্যবহার করুন।
৮. কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহারে সতর্ক থাকুন
যারা কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন, তাদের জন্য সঠিক পরিচর্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। না হলে চোখে মারাত্মক সংক্রমণ হতে পারে।
যেসব বিষয় মনে রাখবেন-
লেন্স ব্যবহার করার আগে হাত ধুয়ে নিন।
নির্দিষ্ট নিয়মে লেন্স পরিষ্কার করুন।
নির্ধারিত সময়ের বেশি লেন্স পরে থাকবেন না।
ঘুমানোর সময় লেন্স পরে থাকবেন না ।
কখনোই সাধারণ পানি দিয়ে লেন্স পরিষ্কার করবেন না।
৯ . পর্যাপ্ত ঘুম
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে চোখ লাল, ক্লান্ত এবং ফোলা দেখা যায়। এটি চোখে শুষ্কভাব, জ্বালা এবং ঝাপসা দেখার কারণও হতে পারে। তাই প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। ভালো ঘুম চোখকে আরাম দেয় এবং স্ক্রিন টাইমের ক্লান্তি কাটাতেও সাহায্য করে।
চোখের যত্ন নেওয়ার জন্য বড় কিছু করতে হবে না। বরং ছোট ছোট অভ্যাসই আপনার চোখকে সুস্থ রাখতে পারে। পরিমিত স্ক্রিন টাইম, স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত চোখ পরীক্ষা – এইসব অভ্যাস আপনাকে দীর্ঘমেয়াদে দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখতে সাহায্য করবে। চোখ আমাদের পৃথিবী দেখার জানালা। তাই আজ থেকেই এই অভ্যাসগুলো শুরু করুন ।
তথ্যসূত্র: আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব অপথালমোলোজি, ওয়েব এমডি, এনএইচএস হাল ইউনিভার্সিটি টিচিং হসপিটাল