আর্কাইভ  বুধবার ● ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ● ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
আর্কাইভ   বুধবার ● ১৯ নভেম্বর ২০২৫

শীতের শহরে হারিয়ে যাওয়া শৈশব

বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, বিকাল ০৬:৫৮

Advertisement

আব্দুর রহমান 

রংপুর শহরের রেলস্টেশন এলাকার সকালটা অন্য শহরগুলোর থেকে আলাদা। কুয়াশা যেন ধোঁয়ার মতো ভেসে থাকে, আর ঠান্ডা বাতাস চামড়া কেটে ঢুকে যায় হাড়ে। এই কুয়াশার মধ্যেই ১২ বছরের সাকিবকে দেখা যায় ভাঙা প্ল্যাটফর্মের কোণে বসে থাকতে। গায়ে একটা পুরোনো সোয়েটার, তার ওপর ছেঁড়া কম্বল। তবুও ঠান্ডা তাকে কাবু করে রাখে।

রাত হইলে দাঁত বাজে। কাগজ জ্বালাইকিন্তু সে আগুন বেশি সময় জ্বলে না,” বলে সাকিব।

রংপুরের শীত পুরো বাংলাদেশের তুলনায় বেশি তীব্র। স্থানীয় NGO চাইল্ড হোপ রংপুর–এর ২০২4 সালের জরিপে দেখা যায়—জেলায় প্রায় ২,৮০০ পথশিশুর মধ্যে ৬৫% শীতে তীব্র হাইপোথার্মিয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

এদের ৪০% শিশু রাস্তার ওপর রাত কাটায়, যাদের বেশিরভাগই স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, চকবাজার, লালবাগ মোড়ের আশপাশে ঘুমায়।

 

সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো—রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত তিন বছরে শীতজনিত রোগে শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৩০%। ডাক্তারদের মতে, এদের বেশিরভাগই সর্দি, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা এবং ফুসফুসের সংক্রমণে ভোগে। চিকিৎসা পাওয়ার আগেই অনেকে গুরুতর অবস্থায় পৌঁছে যায়।

শীতের রাতের সঙ্গে প্রতিদিনের লড়াই

সাকিবের বাবা দুই বছর আগে মারা যায়। মা কাজের সন্ধানে রংপুরে এলেও একটি বাসায় লম্বা সময় ধরে থাকতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাকে দিনাজপুরে গিয়ে হোটেলের কাজ ধরতে হয়।
মা কয়আমাকে রাখলে তাকে কাজে রাখে না। তাই বাইরে থাইকা যাই,” বলে সাকিব।

শীতের রাতে সাকিব সাধারণত স্টেশনের পাশে কাগজ-কুড়ানোর দোকানের সামনে ঘুমায়, কারণ দোকান বন্ধ হওয়ার পর ওখানে কিছুটা বাতাস কম লাগে।
কখনো পলিথিন গায়ে দেইকখনো কম্বলে দুইজন মিলে ঘুমাই। তবুও কষ্ট কমে না,”—কথাগুলো বলার সময় তার ছোট হাত দুটো কাঁপছিল।

NGO– দাবিসহায়তা এখনও অপর্যাপ্ত

NGO কর্মী তন্বী আখতার জানালেন—
রংপুরে অন্তত ১,৫০০ শিশুর জরুরি শীতবস্ত্র প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৩০–৩৫% পর্যন্ত সহায়তা পৌঁছায়।”

অনেক সময়ে শিশুদের কাছে দেওয়া কম্বল কালোবাজারে চলে যায় বলেও অভিযোগ আছে। কিছু পথশিশু কম্বল বিক্রি করে খাবার কিনে, কারণ দিনের শেষে তাদের বাঁচার অগ্রাধিকারই থাকে খাদ্য।

সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রজায়গা কমসুবিধা আরও কম

শীত মোকাবিলায় রংপুর সিটি করপোরেশন কয়েকটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলে। কিন্তু সেখানে স্থান সীমিত—মাত্র ৮০–১০০জন থাকতে পারে। ফলে হাজার হাজার শিশুর মধ্যে মাত্র সামান্যটাই আশ্রয় পায়।
অনেক শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না, কারণ সেখানে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মানতে হয়, যা তাদের পক্ষে কঠিন।
সাকিব বলে, ওইখানে গেলে কাজ করতে দেয় না। খাই কী দিয়া?”

শীত তাদের কাছে ঋতু নয়এটা প্রতিদিনের প্রতিপক্ষ

রংপুরের শীত এখানে বসবাসকারী বহু মানুষের কাছে উৎসব, পিঠা-পায়েস, কম্বলের উষ্ণতা। কিন্তু সাকিবদের কাছে শীত হলো ভয়।
রাত বাড়লে তারা কুয়াশার মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়—তাদের জন্য হয় না কোনো আয়োজন, কোনো আলো।

শৈশবের বয়সে তারা শিখে ফেলে কীভাবে বাঁচতে হয়, কীভাবে ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, কীভাবে ক্ষুধা, ভয়, একাকীত্ব সবকিছু গিলে নিয়ে দিন কাটাতে হয়।

রংপুরের পথশিশুদের এই বাস্তবতা শুধু তাদের নয়—এটা আমাদের সমাজের ব্যর্থতার প্রতীক।
শীতে উষ্ণতার প্রয়োজন শুধু কম্বলে নয়—প্রয়োজন নীতিগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, টেকসই আশ্রয়কেন্দ্র, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মানবিক উদ্যোগ।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। 

মন্তব্য করুন


Link copied