নজরুল মৃধা
প্রতিটি মানুষই আশা করেন তার মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে হউক। বর্তমানে দেশে স্বাভাবিক মৃত্যু বিপদগ্রস্ত। কারণ গণপিটুনিতে মানুষকেই মানুষ নির্মমভাবে মারছে। যারা মারছেন তাদের মধ্যে একধরনের আদিম উন্মাদনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। তা না হলে মানুষ নামটি আর মানুষের থাকবে না।
সম্প্রতি মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) আগস্ট মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ মাসে কমপক্ষে ৩৮টি ঘটনায় ২৩ জন গণপিটুনিতে নিহত ও ৪৩ জন আহত হয়েছেন। এর আগের মাস জুলাইয়ে ৫১টি ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ১৬ জন। গণপিটুনির পেছনের কারণ: প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১০ জনকে চুরির অভিযোগে, চার জনকে সন্দেহভাজন চুরির অভিযোগ এবং তিন জনকে ডাকাতির অভিযোগে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া পূর্বশত্রুতার জেরে দুই জন (একজন নারীসহ), মাদক মামলার অভিযুক্ত হিসেবে একজন, ছিনতাইয়ের অভিযোগে দুই জন এবং চাঁদাবাজির অভিযোগে একজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। এ প্রসঙ্গে এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, প্রতিবেদনে যে সংখ্যাটি উঠে এসেছে, বাস্তবে এর চেয়েও বেশি ঘটনা ঘটছে। মানুষ ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না। এভাবে গণপিটুনির ঘটনা বাড়তে থাকায় এটি আইনশৃঙ্খলার অবনতিরই প্রতিফলন।
গণপিটুনিতে নিহতদের স্বজনরা এইসব হত্যাকান্ডের ন্যায় বিচার কতটুকু পাচ্ছেন এনিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একজন মানুষকে যখন গণপিটুনিতে মারা হয় তখন আশপাশে থাকা কিছু মানুষ ওইসব দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করছেন। এর মধ্যেও এক ধরনের আদিমতা লক্ষ্য করা যায়।
আইনে বলা হয়েছে,গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি নিহত হলে দন্ডবিধির ৩৪ ধারাঅনুযায়ী গণপিটুনিতে অংশ নেয়া সব ব্যক্তি সমানভাবে দায়ী হবেন। কেননা আইনে যৌথ দায়িত্বশীলতা নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায় নিয়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন যেন তিনি নিজেই অপরাধটি করেছেন। গণপিটুনিতে যারাই অংশ নেবেন সেটা আদালতে প্রমাণ করা গেলে সবারই শাস্তি নিশ্চিত করার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে কেউ বড় ধরনের জখম করলেও যে শাস্তি পাবেন, একজন সামান্য ধাক্কা দিলেও একই শাস্তির আওতাভুক্ত হবেন। এছাড়া গণপিটুনিতে যদি কেউ মারা যান আর সেটা যদি খুন হিসেবে আদালতে প্রমাণ করা যায় তাহলে উল্লিখিত খুনের অপরাধে অপরাধীকে ৩০২ দ্বারার অধীনে মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং জরিমানা দন্ডে দন্ডিত করা যায়। সে হিসেবে আদালতে গণপিটুনিতে হত্যা প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী সবারই ন্যূনতম দন্ড হবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড।
দেশে এপর্যন্ত যতগুলো মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন তার কতজন আইনের উল্লেখিত শাস্তি পেয়েছেন এর কোন পরিসংখ্যান নেই। মামলা হলে তদন্ত হবে। সাক্ষি জোগার করে বিচার শুরু হবে। সেটি কতদিন চলবে তা কেউ বলতে পারেে না। গণপিটুনির ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও আলোচনায় না আসলে পুলিশের তেমন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়না । সেই মামলার তদন্ত বিচার ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। কোনকোনটি চলে অনন্তকাল পর্যন্ত।
সম্প্রতি রংপুরের তারাগঞ্জে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লাল নামে দুইজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তারা ছিলেন হরিদাষ সম্প্রদায়ের মানুষ। এই ঘটনায় নিহত রুপলালের স্ত্রী অজ্ঞাত পাঁচ থেকে সাতশ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছেন। গত ৮ আগস্টের ঘটনা এটি। মামলা দায়েয়ের প্রায় এক মাস হতে চলল । পুলিশ এই মামলায় এপর্যন্ত মাত্র ৬জন আসামিকে গ্রেফতার করেছে। অথচ গণপিটুনিতে অংশ গ্রহণ করেন দুই থেকে তিন হাজার মানুষ। আসামি গ্রেফতারে ধীরগতি নিহত পরিবারের মাঝে ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
ঘটনার সময় স্থানীয় লোকজন প্রদীপ দাসের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে চারটি প্লস্টিকের ছোট বোতল বের করে স্থানীয়রা। একটি বোতল খুললে ভেতরে থাকা তরলের ঘ্রাণে সেখানকার দুই ব্যক্তি অসুস্থ বোধ করেন বলে স্থানীয়রা জানান। এ ঘটনায় লোকজনের সন্দেহ বাড়ে। অজ্ঞান করে ভ্যান চুরি সন্দেহে তাদের মারধর শুরু করেন। বটতলা থেকে মারতে মারতে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসা হয় তাদের। মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হলে সেখানে ফেলে রাখা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে তাদের উদ্ধার করে পুলিশ তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে রূপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করা হয়। আহত প্রদীপ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তাদের যখন মারপিট করা হয় তখন তারা দুই হাত জোর করে বলেছিলেন আমরা চোর না। কিন্তু মব সৃষ্টিকারিরা তাদের কথা শোনেন নি। রুপলাল ও প্রদীপকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। কে কখন কোথায় গণপিটুনির শিকার হবেন তা বলা মুস্কিল।
সব শেষে একটি কথা না বললেই নয়। সেটি হল বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী মানুষই। এক প্রতিবেদনে জানাগেছে, প্রতি বছর মানুষের হাতে প্রায় ৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। অন্যান্য প্রাণী যে কত মারা পড়ে মানুষের হাতে, তার হিসেব নেই। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা-র তথ্য মতে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী মোট মৃত মানুষের ০ দশমিক ৭ শতাংশ ঘটেছে মানুষের হাতে। আর মানুষের হাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় লাতিন আমেরিকার এল সালভাদরে। তাই মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে হবে। মানুষের মাঝে যাতে মানবিকতা উদ্ভাসিত হয় এজন্য মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক।