মুকেশ সিংহ
রংপুরের শান্ত, ছায়াময় পরিবেশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়—একটা ক্যাম্পাস যাকে দেখলে প্রথমেই চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ। বাংলাদেশের উত্তরের এই বিশ্ববিদ্যালয় যে শুধু শিক্ষার জায়গা, তা নয়; পুরোটা যেন এক বিশাল সবুজ অভয়ারণ্য। পথ ধরে হাঁটলে মনে হয়, ইট-কাঠের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য প্রকৃতি এখানে নতুন করে ফুসফুস ভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথ থেকেই সেই শান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়। দু’পাশে সারি সারি গাছ, মাঝে পরিষ্কার রাস্তা—যেটা সকালে নরম আলোয় ঝিলমিল করে আর বিকেলে একটা কোমল রঙ ছড়িয়ে দেয়। পাখির ডাক, বাতাসের মৃদু শব্দ আর ছায়াঘেরা পথ মিলিয়ে মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজ হাতে সাজানো একটা মিউজিয়াম। ক্যাম্পাসে ঢোকার সাথে সাথেই যে জিনিসটা সবচেয়ে তাড়াতাড়ি চোখে পড়ে, সেটা হলো সবুজের ঘনত্ব। মনে হয় যেন প্রতিটা গাছ নতুন করে এখানে জন্ম নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ ভবনের আশপাশ বেশ খোলা আর বাতাস চলাচলের উপযোগী করে তৈরি। ভবনের দেয়ালজুড়ে লতা-ঘেরা সবুজ আর গাছের ছায়ায় মোড়া মাঠগুলো যেন ছাত্রছাত্রীদের পড়ার চাপ কমিয়ে একরাশ শান্তি এনে দেয়। বিশেষ করে শীতের সকালে যখন কুয়াশার পর্দা গাছের ডাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে নেমে আসে, তখন পুরো ক্যাম্পাসটা হয়ে ওঠে একেবারে সিনেমাটিক। ক্লাসে যাওয়ার পথে অনেক ছাত্রছাত্রীই মোবাইল দিয়ে মুহূর্তগুলো ধরে রাখে—কারণ সত্যিই, না ধরে পারা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠটা সবুজের দিক থেকে যেন হৃদয়স্থল। বড় বড় গাছের আলতো ছায়া, চারপাশে খোলা জায়গা, আর সামনে অবাধ বাতাস—সব মিলিয়ে জায়গাটা ছাত্রজীবনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। ক্লাসের ফাঁকেফাঁকে কারো দেখা মিলবে বন্ধুদের সাথে আড্ডায়, কেউ বা আবার শান্ত কোণে বসে বই পড়ছে। সন্ধ্যায় যখন আলো-আঁধারের মাঝে মাঠটা নরম পোশাক পরে ফেলে, তখন মনে হয় এখানে সময়ই যেন ধীরে হাঁটে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানগুলোও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নানা ধরনের ফুল, ঋতুভেদে বদলে যাওয়া রঙ—এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে বসন্তে ক্যাম্পাসে ফুলের যে রঙিন আচ্ছাদন দেখা যায়, তা সত্যিই দেখার মতো। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমুল, কাঁঠালচাপা—এসব ফুলে ভরে ওঠে রাস্তার পাশে থাকা গাছগুলো। বাতাসে মিষ্টি গন্ধ মিশে যায়, মনে হয় প্রতিটা দম শ্বাসও আলাদা করে প্রাণবন্ত।
হ্রদঘেরা জায়গাগুলোও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ আকর্ষণ। পানি আর সবুজের এই মেলবন্ধন ক্যাম্পাসের পরিবেশকে আরও কোমল আর প্রাণবন্ত করে তুলেছে। কখনো কখনো দেখা যায়, দুই-তিনজন ছাত্র এক কোণে বসে মাছকে দানা খাওয়াচ্ছে। কেউ কেউ আবার ছবিও তুলতে আসে—কারণ এই জায়গাগুলো এতটাই সুন্দর যে মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজেই সাজিয়ে রেখেছে।
শুধু সৌন্দর্য নয়, পরিবেশগত দিক থেকেও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছপালা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রংপুরের আবহাওয়া তুলনামূলক ঠান্ডা হলেও রোদ ছিল সবসময়ই একটা বিষয়। কিন্তু এই সবুজের পরিমাণ ক্যাম্পাসের তাপমাত্রাকে খুব আরামদায়ক করে তোলে। পাখি, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি—এরা এখানে খুব সহজেই দেখা যায়। পুরো জায়গাটা যেন জীববৈচিত্র্যের একটা ছোট্ট নিরাপদ জায়গা।
এই সবুজ পরিবেশ ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক ইতিবাচক। শহরের বাইরে একটু আলাদা পরিবেশ হওয়ায় পড়ার চাপ থেকে মুক্তি পেতে ছাত্ররা ক্যাম্পাসের যেকোনো একটি ছায়াঘেরা জায়গায় গিয়ে শান্তভাবে কিছুক্ষণ কাটাতে পারে। অনেকেই বলে, ব্রুর সবুজ পরিবেশ নাকি পরীক্ষা-পূর্ব উদ্বেগ অনেকটাই কমিয়ে দেয়। এতটুকু থেকে মনে হয়—ক্যাম্পাস শুধু পড়াশোনার জায়গা নয়; বরং একটা আরামদায়ক আশ্রয়ও।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম এগিয়ে চললেও, প্রকৃতির এই পরিবেশ তার ব্র্যান্ডিংয়ে আলাদা করে ভূমিকা রাখছে। যারা একবার এখানে আসে, তারা এই সবুজে মোড়ানো পরিবেশ ভুলতে পারে না। এমনকি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ব্রু ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যের কথা শুনে এখানে ঘুরতে আসে।
দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্রুর রূপ বারবার বদলায়। সকালটা থাকে ভেজা আলোয় ধরা, দুপুরটা ঝকঝকে, আর সন্ধ্যা নরম রঙের চাদর মেলে দেয়। রাত হলে আবার গাছের ফাঁকে ফাঁকে আলো জ্বলে ওঠে—মনে হয় শান্ত শহরের মধ্যে একটা আলাদা প্রাণ জেগে আছে।
সব মিলিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ইটের বিশ্ববিদ্যালয় নয়; এটা এক বিশাল সবুজ যাদুঘর, যেখানে প্রতিটা গাছ, প্রতিটা ফুল আর প্রতিটা ছায়া শিক্ষা-জীবনকে আরো কোমল, সুন্দর আর স্মরণীয় করে তোলে। এই সবুজই ব্রুকে করেছে উত্তরবঙ্গের অন্যতম নান্দনিক ক্যাম্পাস, যেখানে প্রকৃতি আর জ্ঞানচর্চা হাত ধরাধরি করে এগোয়।
লেখক:শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।