সাদিয়া আক্তার সুচি
বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন শিল্প আজ শুধু রুচি ও সৌন্দর্যের বিষয় নয়, বরং পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। আধুনিক দ্রুতগতির ফাস্ট ফ্যাশন বাজারে প্রতিদিন নতুন পোশাক উৎপাদিত হচ্ছে, আর সেই সঙ্গে বাড়ছে বস্ত্রবর্জ্য, পানি দূষণ ও পরিবেশগত ক্ষতি।
এই পরিস্থিতিতে পরিবেশবান্ধব পোশাক বা সাসটেইনেবল ফ্যাশন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেকেই মনে করেন পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে টেকসই ফ্যাশনের দিকে যাওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ নেই। তবে এর বিপরীতে আবার বিভিন্ন প্রশ্নও উঠে আসে—এটি কি বাস্তবে সবার জন্য সম্ভব? দাম, প্রাপ্যতা, এবং সত্যিকার অর্থে টেকসই কিনা—এসব বিতর্কও সমানভাবে রয়েছে।
পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনের পক্ষে যুক্তি বেশ শক্তিশালী। গবেষক ও পরিবেশবিদদের মতে, প্রচলিত বস্ত্রশিল্পে একটি জিন্স তৈরি করতে বিপুল পরিমাণ পানি ব্যবহার হয়, এবং রঙ বা রাসায়নিক বর্জ্যের একটি বড় অংশই নদী ও জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। অনেক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে পোশাক শিল্প বিশ্বে উল্লেখযোগ্য কার্বন নিঃসরণকারী খাতগুলোর একটি। ফলে অর্গানিক কটন, বাঁশের ফাইবার, হেম্প, পুনর্ব্যবহৃত পলিয়েস্টার বা অন্যান্য পরিবেশবান্ধব উপকরণ ফ্যাশন জগতে ধীরে ধীরে গুরুত্ব পাচ্ছে। এসব উপকরণ কম পানি ব্যবহার করে, রাসায়নিক নির্ভরতার মাত্রাও কম থাকে, এবং দীর্ঘদিন টেকে—যা পোশাককে আরও কার্যকর ও মানুষ-বন্ধব করে তোলে।
তাছাড়া ক্রেতার তাত্ক্ষণিক আনন্দের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক সাশ্রয়ও হয়, কারণ টেকসই উপকরণের পোশাক সাধারণত দ্রুত নষ্ট হয় না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ভোক্তা আচরণ গবেষণায় পাওয়া গেছে যে তরুণ প্রজন্ম এখন শুধু ফ্যাশন নয়, পোশাকের নৈতিক উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও সচেতন হচ্ছে। তাদের কাছে “কম কিনবো, কিন্তু ভালো মানের কিনবো”—এমন ধারণা আগের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই ভোক্তারা এখন থ্রিফট শপিং, পুনর্ব্যবহার, বা পুরোনো কাপড় আপসাইকেলিং-এর মতো অভ্যাসকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছেন। তবে সাসটেইনেবল ফ্যাশনের জোরালো যুক্তির পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো—এটি কি সত্যিই সবার জন্য সহজলভ্য? পরিবেশবান্ধব উপকরণের দাম সাধারণত বেশি, কারণ এগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া এখনো বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃত হয়নি।
বিভিন্ন দেশের ভোক্তা জরিপে দেখা গেছে, পরিবেশবান্ধব পোশাক সম্পর্কে মানুষ ইতিবাচক হলেও অনেকেই উচ্চমূল্যের কারণে নিয়মিত এসব পোশাক কিনতে পারেন না। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে এটি আরও কঠিন। বাস্তবতা হলো, প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটানোই যেখানে চ্যালেঞ্জ, সেখানে বেশি দামের একটি টেকসই পোশাক কেনা অনেকের সামর্থ্যের বাইরে চলে যায়। এর পাশাপাশি রয়েছে “গ্রীনওয়াশিং”–এর সমস্যা।
অনেক বড় ব্র্যান্ড এখন টেকসইতার দাবিতে প্রচারণা চালালেও গবেষণা ও পরিবেশ অধিকার সংগঠনগুলোর পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ওই দাবির পেছনে সত্যিকারের টেকসই উৎপাদন সবসময় থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রচারণা কেবলমাত্র বিপণন কৌশল। ফলে ভোক্তারা প্রকৃত পরিবেশবান্ধব পোশাক শনাক্ত করতে বিভ্রান্তিতে পড়ে।
আবার, টেকসই উপকরণ বা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গেলে উৎপাদকদেরও অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হয়, যা সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে পুরো শিল্পখাত একসঙ্গে টেকসই পথে এগোতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে গবেষণা বলছে, যদিও শুরুতে খরচ বেশি, দীর্ঘমেয়াদে টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই লাভবান হয়।
উৎপাদনে বর্জ্য কমে, পানি ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়, আর পরিবেশবান্ধব ব্র্যান্ড হওয়ার কারণে বাজারে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করা সহজ হয়। অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এখন নিজেদের উৎপাদন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে কম কার্বন নির্গমন, নিরাপদ রাসায়নিক ব্যবহার, এবং পুনর্ব্যবহৃত উপকরণকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর প্রভাব ভোক্তাদের ওপরও পড়ছে; তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে যে পৃথিবীর ভবিষ্যত রক্ষা করতে চাইলে ফ্যাশন শিল্পেও পরিবর্তন প্রয়োজন।
সব মিলিয়ে, সাসটেইনেবল ফ্যাশন নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের একটি দায়িত্বশীল পথ। এতে পরিবেশ রক্ষা যেমন সম্ভব, তেমনই নৈতিক উৎপাদন ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করার সুযোগ রয়েছে। তবে এর চ্যালেঞ্জগুলো বাস্তব—মূল্য, প্রাপ্যতা, সচেতনতার অভাব এবং গ্রীনওয়াশিং–এর মতো সমস্যা এখনো উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম সচেতন হচ্ছে, পরিবেশবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে, এবং ব্র্যান্ডগুলোও দায়িত্ব নিতে বাধ্য হচ্ছে। একসঙ্গে কাজ করলে এবং সত্যিকারের টেকসইতার নীতি মেনে চললে সাসটেইনেবল ফ্যাশন শুধু একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড নয় বরং একটি টেকসই ভবিষ্যতের বাস্তব ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।