সৈকত খন্দকার
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাটলে চোখে পড়ে খেজুর গাছের মাথায় ঝুলে থাকা কলসির সারি। গাছের গা বেয়ে টুপটুপ করে ঝরে পড়া কাঁচা রসের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে চারদিক। শীত মৌসুমে সংগ্রহ করা এই রস শুধু মৌসুমী খাবারই নয় বরং অনেক অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবিকা চালিকাশক্তিও বটে।
একজন গাছির ভোর এবং রসের কাহিনী:
ঠাকুরগাঁও এর নারগুন খেজুর বাগানের একজন গাছি বলেন," শীতের মৌসুমে তাদের কার্যক্রম শুরু হয় রাত তিনটায়। গাছে ওঠা থেকে শুরু করে গাছ ছাঁটা, হাড়িঁ লাগানো এসব যথা সময়ে না হলে রসের অপচয় হয়।"
মোট ছয়জন নিয়ে তার পরিবার। খেজুরের রস এবং রস থেকে তৈরি গুড়ের ওপর নির্ভরশীল তারা।এটি তাদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। প্রতি মৌসুমে তিনি প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টি গাছ থেকে রস আহরণ করেন। তিনি জানান,যদি মৌসুম ভালো হয় এবং রস উৎপাদন বৃদ্ধি পায় তবে তিনি পুরো বছরের খরচ সামলে নিতে পারেন।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন হাজার হাজার গাছি রয়েছেন যাদের জীবিকার মূল উৎস এই খেজুরের রস। বিভিন্ন জেলা যেমন যশোর, কুষ্টিয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় খেজুরগাছ কেন্দ্রিক মৌসুমী কর্মসংস্থান তৈরি হয় লাখেরও বেশি মানুষের। রস আহরণ, গুড় তৈরি,পরিবহন এবং বিক্রয় প্রতিটি ধাপের ব্যপক পরিশ্রম এবং অভিজ্ঞতা প্রয়োজন।
রস বাজারজাতকরণ ও আঞ্চলিক অর্থনীতির বিকাশ:
আমাদের দেশে খেজুরের রস সংগ্রহ করার জন্য খুব অল্প সময় পাওয়া যায়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূলত রস সংগ্রহ করে থাকে গাছিরা। এই সামান্য সময়ের মধ্যেই খেজুর রসকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ বাজারে যে অর্থনৈতিক বিকাশ হয় তা সত্যিই অতুলনীয়।
প্রতিদিন সকালে স্থানীয় বাজারে রস ক্রেতারা ভিড় জমান। কেউ কাঁচা রস কেনেন আবার কেউ আগুনে জ্বাল দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি পাটালি গুড় কেনেন। একটি বড় কলসি থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০ লিটার রস পাওয়া যায় যার খুচরা বিক্রয়মূল্য প্রতিলিটার প্রায় ৬০ থেকে ১০০ টাকা এলাকাভেদে। আর আগুনে জ্বাল দিয়ে তৈরি পাটালি গুড় বিক্রি হয় প্রতি কেজি প্রায় ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা স্থানভেদে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম দাম হয়,এটি মুলত রস প্রাপ্যতার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে।
একজন স্থানীয় বাজার ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান যে," বর্তমানে নানান রোগ ব্যধি বেড়ে যাওয়াতে মানুষ চিনির পরিবর্তে গুড় ব্যবহারে অগ্রসর হচ্ছেন,যার ফলের গুড়ের চাহিদা ব্যপক হারে বেড়েছে।শহরে এই চাহিদা আরও বেশি। প্রতি মৌসুমে তিনি গুড় বিক্রি করেই লাখ টাকার ব্যবসা করেন।"
শহরে চাহিদা বাড়ছে, পরিবর্তন হচ্ছে বাজার:
একটা সময় ছিলো যখন শুধু গ্রামের হাট বাজারেই কেনা বেচা হতো খেজুরের রস এবং গুড়।কিন্তু এখন চিত্র পাল্টে গেছে। শহরের সুপার শপ থেকে শুরু করে নামীদামী সব দোকানে বিক্রি হচ্ছে গুড়ের প্যাকেজড সংস্করণ। অনেকে অনলাইনে গুড়ের ব্যবসা করেও সফলতার মুখ দেখছেন। বড় বড় রেস্তোরাঁগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে গুড়। খাদ্যগুণ ও বিশুদ্ধতার কারণে শহরের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা বাড়ছে এই গুড়ের।
অনলাইন প্লাটফর্মে গুড় ব্যবসায়ী তারেক আজিজকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন," প্রচুর চাহিদা রয়েছে এই গুড়ের।মাঝে মাঝে ডেলিভারি দিতে হিমশিম খেতে হয় তাকে।লাভও হয় ভালো। "
তরুণ উদ্যোক্তা কামরুল ইসলাম জানান," তিনি স্থানীয় গাছিদের সাথে চুক্তি করে রস সংগ্রহ করেন এবং আধুনিক প্রক্রিয়ায় ফুটিয়ে প্যাকেজ করেন। এতে পণ্যের গুণাগুণ ও ঠিক থাকে এবং বাজারমূল্য বাড়ে।"
এই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু ব্যবসায়ীদেরকেই নয় বরং গাছিদের জন্যও লাভজনক। তাদেরকে আর কম দামে রস এবং গুড় বিক্রি করতে হচ্ছে না। তারা মোটামুটি ন্যায্যমূল্যই পাচ্ছেন।
প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও বাজার চ্যালেঞ্জ :
প্রতিটি খাতে লাভের পাশাপাশি কিছু ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হলো আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা। কখনো কখনো শীতেও বৃষ্টি হয়,তখন রস উৎপাদন কমে যায়।আবার কখনো কখনো পুরো মৌসুম জুড়েই থাকে রসের অপ্রতুলতা। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণেও অনেক এলাকায় খেজুর গাছের সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে।
গাছি শাহ আলম বলেন," দিনে দিনে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে,মালিকরা তাদের গাছ কেটে ফসলী জমি বানাচ্ছেন। এভাবে গাছের সংখ্যা কমতে থাকলে তারা কর্মশূণ্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন।"
বাজারে প্রবেশ করেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের রাসায়নিক রং এবং অন্যান্য উপাদান মিশ্রিত ভেজাল গুড় যার ফলে প্রকৃত গুড় উৎপাদকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং মানসম্মত পণ্য তার দাম হারাচ্ছে।
গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও রপ্তানির স্বপ্ন নতুন দিক উন্মোচন করবে:
বিভিন্ন গবেষকরা মনে করেন,যদি এই শিল্পকে টেকসইভাবে গড়ে তোলা যায় তবে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গাছিদের জন্য সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, আধুনিক চুলা ও বিশুদ্ধতার মানদণ্ড নিশ্চিত করা গেলে পণ্যের মান ও উৎপাদন বাড়বে।
এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ব্যুরোর এক কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের গুড়ের সম্ভাবনা রয়েছে।এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশীদের বাজারকে লক্ষ্য করে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে অবশ্যই পণ্যের দাম, মান ও ফুড সেভটি স্ট্যান্ডার্ড নিশ্চিত করতে হবে।
শীতের স্বাদে গ্রামীণ মানুষের স্বপ্ন :
খেজুরের রস শুধুমাত্র মৌসুমী খাবারই নয়, বিভিন্ন পরিবারের আয়ের উৎস এটি। অনেকের কাছে শীতের আনন্দও এটি। নানি দাদির বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এক গ্লাস খেজুর রস বা একটুকরো পাটালি গুড় মুখে দিলে জীবনের স্বাদই বদলে যায়। এর সঙ্গে মিশে রয়েছে গাছিদের কঠোর পরিশ্রম আর ঐতিহ্যের গল্প। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এই ঐতিহ্য একটি টেকসই অবস্থানে পৌঁছাবে এমনটাই বিশ্বাস গাছিদের।
কুয়াশার বুক চিড়ে যেভাবে ভোরের সূর্যালোক উঁকি দেয়, সেভাবেই খেজুর রস হয়ে উঠবে গাছিদের মৌসুমি অর্থনীতি এবং ভাগ্য বদলের চাকা। খেজুর রসের মৌ মৌ গন্ধ ডেকে আনুক গাছিদের সুদিন,হয়ে উঠুক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।