নিউজ ডেস্ক: গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা-১) আসনটি পৌরসভাসহ ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ আসনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ভোটের মাঠে লড়াই করতে চায় বিএনপি। জামায়াত তাদের দাওয়াতি কাজের পাশাপাশি ভোটারদের কাছে ভোট চাইছে। এরই মধ্যে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাজেদুর রহমান মাজেদকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। অন্যদিকে বিএনপি এখনো ভোটের মাঠে খেলার মতো কোনো প্রার্থী তৈরি করতে পারেনি। দীর্ঘদিন থেকেই এ আসনে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। তবে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর মাঠ পর্যায়ে ভোট বাড়ছে বিএনপির। কিন্তু এ আসনে বিএনপি থেকে কাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। সে বিষয়ে এখনো কোনো বার্তা পায়নি দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার অধিকাংশ অংশ চরাঞ্চল। প্রতি বছর নদীভাঙনের শিকার হয় এ অঞ্চলের মানুষ। নদীতে বিলীন হয় তাদের বসতবাড়ি, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান অনুন্নত। চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত কয়েক লাখ মানুষ। যাতায়াতের ব্যবস্থা অন্যান্য উপজেলার চেয়ে অনেক খারাপ। চরাঞ্চলের মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরগঞ্জে বছরের পর বছর নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। তিস্তার করাল গ্রাস থেকে জনপ্রতিনিধিরা বার বার জনগণকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেনি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এ অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। জনপ্রতিনিধিদের ভাগ্যের উন্নয়ন হলেও জীবন বদলায়নি সাধারণ মানুষের।
যদি বাইরে থেকে কাউকে প্রার্থী দেওয়া হয়। সেই ব্যক্তিকে যদি নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ না চেনে। তাহলে কী বিশ্বাসের ওপর তাকে ভোট দেবে। আমি আশা করছি, আমার দল স্থানীয় তরুণ, যিনি দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন। আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন, নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তাকে মনোনয়ন দেবে।
স্থানীয় ভোটার ইসমাইল হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে আমরা মনের মতো কোনো প্রার্থী পাইনি। বিগত যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে সেগুলোতে মানুষ তার পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। এবার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করবে এমন প্রার্থী পেলে সবাই ভোট দিতে যাবে।
আরেক ভোটার ইমরুল ইসলাম বলেন, বিগত তিনটি নির্বাচন হয়েছে। সেগুলোকে নির্বাচনই বলা যাবে না। ওই তিন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগ ভাই ভাই হিসেবে ভাগাভাগির নির্বাচন করেছে। ভোটাররা কেন্দ্রে ভোট দিতে না গেলেও তাদের ভোট কারচুপি করে ব্যালটে মেরে নেওয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলে জনগণ তাদের মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে।
তরুণ ভোটার সাইফুল ইসলাম হিরুন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সাধারণ জনগণকে ভোট থেকে বঞ্চিত করেছে। মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। আগামী নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের জন্য সুযোগ এসেছে। এবার ঠিকই তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনগণের মনোনীত প্রার্থীকে বেছে নেবে।
আরেক ভোটার বলেন, এবারের নির্বাচনে দল নয়, ব্যক্তিই প্রাধান্য পাবে। ভোটারদের সেই সুযোগ এসেছে। মানুষ দীর্ঘদিন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এবার সেই বঞ্চনার শিকার হতে হবে না। যোগ্য ব্যক্তিকে তারা ব্যালটের মাধ্যমে রায় দেবে।
এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক বাবুল আহমেদ, সদস্য সচিব মাহমুদ ইসলাম প্রামাণিক, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি খন্দকার ডা. জিয়াউল আহসান জিয়াসহ অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে।
আমি এই উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার এবং দলের প্রতি এই উপজেলার মানুষের ভালোবাসা আছে। সারাদেশের মানুষের কাছে সুন্দরগঞ্জ জামায়াত-শিবিরের এলাকা হিসেবেই পরিচিত। আমি নির্বাচিত হলে এলাকার মানুষের খাদেম হয়ে শুধু কাজ করতে চাই।
উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক গোলাম আযম সরকার বলেন, সাধারণ মানুষ বিএনপিকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমাদের ভোটে মাঠ পর্যবেক্ষণ করে দেখছি। মানুষ দীর্ঘদিন থেকে ভোট থেকে বঞ্চিত। আমাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ১৬ বছরের জেল-জুলুম এবং নির্যাতনের শিকার। আমরা তৃণমূল নেতাকর্মীরা আশা করছি, বিগত ১৬ বছর যেসব নেতাকর্মী জেল-জুলুম-নির্যাতনে শিকার হয়েছেন, মানুষের জন্য কাজ করবেন। এমন একজনকে মনোনয়ন দিলে আমরা নতুন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ভোটে ধানের শীষ বিজয়ী করে ইতিহাস রচনা করতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, যদি বাইরে থেকে কাউকে প্রার্থী দেওয়া হয়। সেই ব্যক্তিকে যদি নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ না চেনে। তাহলে কী বিশ্বাসের ওপর তাকে ভোট দেবে। আমি আশা করছি, আমার দল স্থানীয় তরুণ, যিনি দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন। আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন, নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তাকে মনোনয়ন দেবে। বিএনপি আগের মতো আর ভুল করবে না।
সদস্য সচিব মাহমুদ ইসলাম প্রামাণিক বলেন, ‘আমি এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। দুর্দিনে সবসময় নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। বিএনপি নেতাকর্মীরা দীর্ঘ ১৬ বছর ফ্যাসিস্ট দ্বারা নির্যাতনে শিকার হয়েছেন। আমিও ফ্যাসিস্টের নির্যাতনের শিকার হয়ে মামলার ঘানি টেনেছি, জেল খেটেছি। আমাকে দল থেকে মনোনয়ন দিলে নির্যাতিত নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করতে পারবো। দীর্ঘদিন থেকে আমি মানুষের পাশে আছি। আশা রাখছি দল আমাকে মনোনয়ন দিয়ে মূল্যায়ন করবে।’
দীর্ঘদিন থেকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সাধারণ জনগণকে ভোট থেকে বঞ্চিত করেছে। মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। আগামী নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের জন্য সুযোগ এসেছে। এবার ঠিকই তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনগণের মনোনীত প্রার্থীকে বেছে নেবে।
জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মাজেদুর রহমান মাজেদ বলেন, দল থেকে আমাকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আগে দুবার এমপি প্রার্থী ছিলাম। মানুষ আমাকে ভোট দিতে পারেনি। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। আমাকে ভোট দিতে পারেননি, সেই হতাশা আমি ভোটারদের চোখমুখে দেখতে পেরেছি। আমি এই উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার এবং দলের প্রতি এই উপজেলার মানুষের ভালোবাসা আছে। সারাদেশের মানুষের কাছে সুন্দরগঞ্জ জামায়াত-শিবিরের এলাকা হিসেবেই পরিচিত। আমি নির্বাচিত হলে এলাকার মানুষের খাদেম হয়ে শুধু কাজ করতে চাই।
এ আসনটি ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে ১৯৮৪ সালে গঠিত হয়। ১৯৮৬- ৯৬ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন হাফিজুর রহমান প্রামাণিক। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে আবারও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন ওয়াজিদুজ্জামান সরকার। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা আব্দুল আজিজ নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদে মহাজোটের প্রার্থী আব্দুল কাদের খান লাঙ্গল প্রতীকে জয় লাভ করেন। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম নির্বাচিত হন। তিনি সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ায় ২০১৭ সালের ওই আসনে উপ-নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে গোলাম মোস্তফা এমপি নির্বাচিত হন। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে উপ-নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী জয়লাভ করেন।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের ভাগের আসন হিসেবে জাতীয় পার্টি পায়। লাঙ্গল প্রতীকে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী মহাজোট থেকে পুনরায় টিকিট পেলেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি আর আওয়ামী লীগের দাসত্ব করায় জনগণের কাছে অপরিচিত মুখ ছয় মাস ভোটের মাঠে কাজ করা স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল্লাহ নাহিদ নিগারের কাছে হেরে যান। যদিও আওয়ামী লীগের আমলে হওয়া ২০১৪ সালের বিনাভোট, ২০১৮ সালের রাতের ভোট ও ২০২৪ এর ডামি নির্বাচনের প্রতি জনআস্থা নেই।
এ আসনে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪ লাখ ১৮ হাজার ৫৯৯ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এরমধ্যে এবার নতুন করে ভোটার হয়েছেন ১৯ হাজার ৫৫৬ জন।