আর্কাইভ  শনিবার ● ১৬ আগস্ট ২০২৫ ● ১ ভাদ্র ১৪৩২
আর্কাইভ   শনিবার ● ১৬ আগস্ট ২০২৫

আন্দোলন দমনে পুলিশের প্রাণঘাতী অস্ত্রের মজুত ৭ গুণ বাড়ানো হয়েছিল

শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫, দুপুর ০২:৪৩

Advertisement Advertisement

নিউজ ডেস্ক:  জুলাই অভ্যুত্থানের অনেক আগেই পুলিশ বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্রে সজ্জিত করে তোলা হয়েছিল। শেখ হাসিনা গত বছরের ১৮ জুলাই বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের জন্য টেলিফোনে নির্দেশ দেন। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানে তিন সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে কেন এত মানুষ প্রাণ হারান তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে পুলিশের অস্ত্রভাণ্ডারের দিকে।

সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অভ্যুত্থানের আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশ পুলিশ প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্রের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি প্রাণঘাতী অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুত করেছিল। ফলে বিক্ষোভ দমনে পুলিশ সেই অস্ত্রই ব্যবহার করেছে যেগুলো তৈরি-ই করা হয়েছে মানুষকে হত্যার জন্য।

প্রাণঘাতী অস্ত্রের পেছনে পুলিশের বিপুল ব্যয়

২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ ২ কোটি ৪৯ লাখ পিস প্রাণঘাতী গুলি কেনে। একই সময়ে টিয়ার গ্যাস এবং রাবার বুলেটের মতো সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল মাত্র ৩০ লাখ ইউনিট, যা প্রাণঘাতী অস্ত্রের সাত ভাগের এক ভাগ মাত্র।

আমদানি নথি অনুযায়ী, এই তিন বছরে প্রাণঘাতী অস্ত্রের জন্য ২৪০ কোটি টাকা খরচ করা হয়, যা রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাসের মতো সরঞ্জামের জন্য ব্যয় করা ১৯১ কোটি টাকার প্রায় দেড় গুণ বেশি।

পুলিশের অস্ত্রের পেছনে এই বিনিয়োগ গত বছরের জুলাই-আগস্টে দেশে ভয়াবহ প্রাণহানি ঘটাতে ভূমিকা রাখে। প্রশ্ন ওঠে, একটি বেসামরিক বাহিনীর হাতে সামরিক গ্রেডের অস্ত্র তুলে দেওয়া কতটা যৌক্তিক।

বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধের রাইফেল

গণঅভ্যুত্থানের দুই বছর আগে, ২০২২ সালে, পুলিশ ১৮ হাজার ৭.৬২ মিমি সেমি-অটোমেটিক রাইফেল আমদানি করে।

পরবর্তীতে এই অস্ত্রগুলো দিয়েই বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে দেখা যায়, যা বিবিসি বাংলা, আলজাজিরা, দ্য ডেইলি স্টার এবং জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে উঠে আসে। এই রাইফেলগুলোর জন্য মজুত ছিল ১০ লাখ তাজা গুলি।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের বর্ম ভেদ করার জন্য এই গুলি তৈরি করা হয়েছে, সাধারণ কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য নয়। সেনাবাহিনী এবং বিজিবি, র‍্যাবের মতো আধা-সামরিক বাহিনীর কাছেই এ ধরনের অস্ত্র থাকে। বেসামরিক প্রয়োজনে এই গুলি কেনার কোনো সুযোগ নেই।'

২০২৪ সালের জুলাইয়ে বর্তমান শ্রম ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, 'পুলিশের ব্যবহৃত ৭.৬২ মিমি রাইফেলের দুটি মোড রয়েছে—একক এবং র‍্যাপিড ফায়ারিং। আমরা ভিডিওতে দেখেছি, তারা বেশিরভাগই র‍্যাপিড-ফায়ার মোড ব্যবহার করেছে, যা মূলত যুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়।'

তার ভাষ্য ছিল, এগুলো হলো চীনের তৈরি 'সেরা কিলিং মেশিন'।

এই বছরের জানুয়ারিতে, পুলিশ সদর দপ্তরের 'আর্মস অ্যান্ড অ্যামুনিশন এনটাইটেলমেন্ট কমিটি' হতাহত কমাতে ৭.৬২ মিমি রাইফেলের পরিবর্তে পিস্তল ব্যবহারের সুপারিশ করে।

এত বিপুল সংখ্যায় প্রাণঘাতী অস্ত্র সংগ্রহের যৌক্তিকতা এবং এই অস্ত্রগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা কী, সে সম্পর্কে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দেয়নি পুলিশ সদর দপ্তর।

ব্যাখ্যাতীত অস্ত্রের সংগ্রহ

পুলিশের অস্ত্রভান্ডার শুধু ৭.৬২ মিমি রাইফেল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল না। ২০২২ সালে তারা দুই ধরনের মেশিনগানও সংগ্রহ করে।

একটি ছিল তুরস্কের তৈরি ৯ মিমি এমএসজি-৯পি সাব-মেশিনগান (এসএমজি)। টুইন-ম্যাগাজিনের এই অস্ত্রের একটি চালান ছিল ৭.৫২ টনের। এর প্রতিটি ম্যাগাজিনে গুলি থাকে ৩০টি করে। তখন ৫১ কোটি টাকারও বেশি খরচ করা হয় এই অস্ত্রের পেছনে। যদিও এর সঠিক ফায়ারিং রেঞ্জ, মাজল ভেলোসিটি এবং ফায়ার রেট (প্রতি মিনিটে রাউন্ড) স্পষ্ট নয়, তবে একই ধরনের অন্যান্য মডেলের এসএমজি প্রতি মিনিটে কয়েকশ রাউন্ড গুলি ছুড়তে পারে।

অন্য অস্ত্রটি আরও ভয়ঙ্কর—ক্রু-সার্ভড ১২.৭x৯৯ মিমি ন্যাটো মেশিনগান, যা ব্রাউনিং মেশিনগান নামেও পরিচিত। এই অস্ত্র ট্রাইপডের ওপর বসিয়ে দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে গুলি করার জন্য ব্যবহৃত হয়। অভ্যুত্থানের সময় এই অস্ত্র ব্যবহারের কোনো প্রমাণ অবশ্য পায়নি গণমাধ্যম।

সেনাবাহিনীর অর্ডন্যান্স ডিরেক্টরেটের একজন প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই অস্ত্র হেলিকপ্টার বা বিমান ভূপাতিত করার জন্য তৈরি, বেসামরিক নাগরিকদের জন্য নয়।

ওই কর্মকর্তা বলেন, এই অস্ত্রটি দৈর্ঘে প্রায় পাঁচ ফুট। এর প্রতিটি বুলেট ছয় ইঞ্চি লম্বা। বন্দুকটি এত বড় যে এটি চালাতে দুজন লোক লাগে। একজন গুলি চালায়, অন্যজন ম্যাগাজিন ফিড করে। এটি প্রতি মিনিটে কয়েকশ রাউন্ড গুলি ছুড়তে পারে।

তিনি বলেন, পুলিশের এই অস্ত্রের প্রয়োজন হতে পারে, এটা কল্পনাও করা যায় না।

পুলিশের সামরিকীকরণের পূর্বাপর

২০১৪ সালের অক্টোবরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকের পর পুলিশের সামরিকীকরণ শুরু হয়।

ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকা পুলিশের একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজি গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ 'নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন' ছিল, এমন যুক্তি দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

এর পরের দশকজুড়ে পুলিশকে অস্ত্রে সজ্জিত করার এই প্রবণতা বাড়তেই থাকে। ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পুলিশ ১৪,৬০০টি গ্লক পিস্তল এবং ৮,০০০টি অন্যান্য ৯ মিমি পিস্তল কেনে, যার জন্য ১৫ লাখ রাউন্ড গুলি মজুত ছিল।

জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন তাদের তদন্তের সময় পুলিশের কাছ থেকে একটি প্রতিবেদন পায়, যেখানে পুলিশ স্বীকার করে যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, কুমিল্লা, চাঁদপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, মাগুরা, ভোলা, ময়মনসিংহ এবং মানিকগঞ্জে বিক্ষোভ দমনের জন্য ৭.৬২ মিমি রাইফেল, এসএমজি এবং গ্লক পিস্তল মোতায়েন করা হয়েছিল।

বুলেটের হিসাব, লাশের সারি

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গবেষক ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, তিনি ও তার সহকর্মীরা অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের দায়ের করা ১০০টি মামলা বিশ্লেষণ করে অন্তত ৪,৬৩৪ বার তাজা গুলি ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছেন। তারা ৭.৬২ মিমি সেমি-অটোমেটিক রাইফেল, সাব-মেশিনগান, বিডি০৮ অ্যাসল্ট রাইফেল এবং বিভিন্ন ধরনের পিস্তল ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা পুলিশের নিজস্ব তথ্য থেকেই দেখেছি যে তারা টিয়ারগ্যাস বা রাবার বুলেটের চেয়ে প্রাণঘাতী অস্ত্র বেশি ব্যবহার করেছে। এর থেকেই বোঝা যায় তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ প্রাণঘাতী অস্ত্র ছিল।'

বিক্ষোভকারীদের ওপর সিসার ছররা গুলি (লেড পেলেট) ব্যবহারও প্রাণঘাতী প্রমাণিত হয়। এই গুলিতে মারা যায় ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ। ১৮ জুলাই ধানমন্ডিতে তার শরীর শটগানের পেলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায়।

২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পুলিশ ১৮ হাজার ১২-বোর শটগান কেনে এবং সিসার গুলি কেনার জন্য সাড়ে ১৬ কোটি টাকা খরচ করে।

আইনগত বৈধতার প্রশ্ন

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান বলেন, সেনাবাহিনীর ছাড়পত্র ছাড়া পুলিশের 'নিষিদ্ধ বোরের' অস্ত্র আমদানি করা আইনত সম্ভব নয়। উল্লিখিত প্রায় সব প্রাণঘাতী অস্ত্রই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

শুল্ক বিভাগের সূত্রমতে, এসএমজি এবং মেশিনগানগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেলেও ৭.৬২ মিমি রাইফেলগুলো পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) ছাড়পত্রে খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে চালান খালাসের জন্য চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ স্বাক্ষর করে। তবে এর জন্য সেনাবাহিনীর অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, কোনো নথিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

অস্ত্র আসে বিভিন্ন দেশ থেকে

বাংলাদেশ পুলিশকে অস্ত্র সরবরাহে শীর্ষে ছিল তুরস্ক। দেশটির আটটি কোম্পানি ১৩৪ কোটি টাকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে ছিল সাব-মেশিনগান, পিস্তল, ১২-বোর শটগান এবং সিসার গুলি। যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি কোম্পানি থেকে কেনা হয় ৫৬ কোটি টাকার অস্ত্র, যার মধ্যে ছিল ক্রু-সার্ভড মেশিনগান এবং গ্লক পিস্তল। এ ছাড়া, চীনের ছয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৪ কোটি টাকার অস্ত্র কেনা হয়। স্পেন ও সাইপ্রাস থেকেও সাড়ে আট কোটি টাকার সিসার গুলি আমদানি করা হয়।

মন্তব্য করুন


Link copied