নিউজ ডেস্ক: চব্বিশের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বুক ও পেট পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তার গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিলো ছররা গুলির আঘাত। কিন্তু মৃত্যুর পর ৩০ জুলাই ময়নাতদন্তের ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাজিবুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বদলাতে আমাকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসার প্রলোভন দেখানো। তখন আমার পাসপোর্ট নেই তাদের জানালে, তারা আমাকে দুই সপ্তাহের জন্য কক্সবাজার ঘুরে আসার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন আমি বলেছি আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য সারা বিশ্বে লাইভে সম্প্রচারিত হয়েছে। আমি যদি হেড ইনজুরিতে মৃত্যু হয়েছে মর্মে রিপোর্ট দেই, তাহলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মানুষ ডাক্তার সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখবে।
চাপ দিয়ে মোট ৪ বার প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়েছিল। মাথায় আঘাত, বিভিন্ন ক্ষত এবং সাঈদের শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত জমাট বাঁধার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে হয়। বলা হয়, এসব আঘাতের কারণে ‘শক’ এবং ‘রক্তক্ষরণে’ আবু সাঈদের মৃত্যু হয়। তারপরও তিনি তা লেখেননি। প্রচণ্ড চাপে পড়ে তিনি সর্বশেষ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিজের জবানবন্দিতে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে এমন তথ্য তুলে ধরেন ডা. রাজিবুল ইসলাম।
রোববার (২৪ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ এমন জবানবন্দি দেন তিনি। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের ১৮তম সাক্ষী হিসেবে তারা সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন- প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদসহ অন্যরা। শুনানি শেষে একজনকে একদিন করে মোট চারদিন জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত।
জবানবন্দিতে ড. রাজিবুল ইসলাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, আবু সাঈদ শটগান পিলেটের আঘাতে মারা যান। কিন্তু বাইরে থেকে চাপ দিয়ে চতুর্থবার ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয় তাকে। চাপে পড়ে পঞ্চমবারের প্রতিবেদন দিয়েছেন তিনি।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বদলাতে ওই ফরেনসিক চিকিৎসক ৪ জনের কাছ থেকে চাপ আসার কথা জবানবন্দিতে জানিয়েছেন ড. রাজিবুল ইসলাম। যারা সবাই ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ। এদের মধ্যে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দুজন সাবেক উপ-কমিশনার, রংপুর মেডিকেল কলেজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগপন্থি ডাক্তারদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) একজন নেতা রয়েছেন।
মো. রজিবুল ইসলাম তার জবানবন্দিতে বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করি। আবু সাঈদের শরীরে পিলেট পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে আবু সাঈদের শরীরে বিভিন্ন স্থানে অনেক পিলেটবিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণজনিত কারণে আবু সাঈদ মৃত্যু বরণ করেছে মর্মে আমি মতামত দিয়েছি। সেখানকার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে উক্ত রিপোর্ট জমা দিতে যায়। কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে রিপোর্ট গ্রহণ না করে পুনরায় রিপোর্ট তৈরি করতে বলে।
তিনি আরও বলেন, একই রিপোর্ট দ্বিতীয়বারও ভাষাগত পরিবর্তন করে পেশ করি। কিন্তু সেটাও গ্রহণ করা হয়নি। এভাবে আমি তৃতীয় প্রতিবেদনও পেশ করি। চতুর্থবার প্রতিবেদন দেওয়ার আগে ৩০ জুলাই রংপুর মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের (মাহফুজুর রহমান) তার রুমে আমাকে ডেকে নেয়। সে সময়ে ডিজিএফআই, সিটিএসবি, পুলিশের ডিসি ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি (রংপুর) ডাক্তার চন্দন উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় রুমের বাইরে অবস্থান করছিলেন ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তারা। তারা আমাকে বুলেট ইনজুরির পরিবর্তে হেড ইনজুরির কথা উল্লেখ করে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তৈরি করার চাপ দেন। তাদের মন মতো প্রতিবেদন না হলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলেও ওই সময় জানানো হয়। আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে বলেও তারা আমাকে জানায়। তারা আমাকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসার প্রলোভন দেখায়। তখন আমি বলি আমার পাসপোর্ট নেই, এরপর তারা আমাকে দুই সপ্তাহের জন্য কক্সবাজার ঘুরে আসতে বলে, আমি বলি আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য সারা বিশ্বে লাইভে সম্প্রচারিত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি যদি হেড ইনজুরিতে মৃত্যু হয়েছে মর্মে রিপোর্ট দেই, তা হলে শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের মানুষ ডাক্তার সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখবে। এরপর সাচিবের সভাপতি ডাক্তার চন্দন আমাকে বলেন, আবু সাঈদের লাশ নিয়ে ব্যবসা চলছে। নেত্রী (শেখ হাসিনা) এ ব্যাপারে কনসার্ন আছেন। পুলিশ যেভাবে রিপোর্ট চায় সেভাবে রিপোর্ট দিয়ে দাও। তোমার বিষয়টা আমরা দেখবো। এতো কিছুর পরেও আমি আমার অবস্থান থেকে সরে আসিনি। আমি কোনো হেড ইনজুরি পাইনি। সর্বশেষ চতুর্থবার আমার প্রদত্ত প্রতিবেদন ইনজুরির বর্ণনা ঠিক করলেও গানশর্ট ইনজুরির কথা উল্লেখ করিনি। পিলেট ইনজুরিসহ অন্যান্য বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদন পেশ করি। তারপর তারা সেটি নিয়ে যায়।
ড. রাজিবুল ইসলাম বলেন, আমাকে অনবরত হুমকি দেওয়ার পরেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি সত্য প্রতিবেদন দেই। যে তিনটি প্রতিবেদন আগে ফেরত দেওয়া হয়েছিল, তা আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে পেরেছি।