নিউজ ডেস্ক: জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ক্রমাগত ‘কুরুচিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর’ বক্তব্যের অভিযোগে দলের দেওয়া শোকজের জবাব দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বরাবর লিখিতভাবে শোকজ নোটিশের জবাব জমা দেন তিনি।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিএনপির মিডিয়া সেল।
লিখিত জবাবে ফজলুর রহমান উল্লেখ করেন, ২৪ আগস্ট রাত ৯টায় রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানোর নোটিশ তিনি হাতে পান। পরে যথাসময়ে জবাব দেওয়ার জন্য সময় বাড়ানোর আবেদন করলে তাকে ২৪ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়। এজন্য তিনি কৃতজ্ঞতা জানান।
নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি লিখেছেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’।
তিনি দাবি করেন, কোনোদিনই কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেননি। বরং ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যার পর তিনিই প্রথম বলেছিলেন, আবু সাঈদ একুশ শতকের প্রথম ‘বীরশ্রেষ্ঠ’। তার বক্তব্যে সবসময়ই জুলাই-আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি ইসলাম ধর্মে ও আল্লাহ-রাসুলে বিশ্বাসী একজন মানুষ। তবে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে সবসময়ই কথা বলেছেন এবং ভবিষ্যতেও বলবেন।
ফজলুর রহমান তার জবাবে একে একে ১১টি বিষয় স্পষ্ট করেন। তিনি লিখেছেন, কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরুতে ছিল নির্দলীয় চরিত্রের, রাজনৈতিক দাবি থেকে মুক্ত। সেই সময়ে ইউটিউবের মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, শুধু চাকরি নয়, গণতন্ত্রের জন্যও আন্দোলন করতে হবে। জুলাই আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি জীবনহানির আশঙ্কা নিয়েও যুক্ত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশ সরকার মাত্র এক ঘণ্টার হামলায় ভেঙে দেয়। তখন ২৫ হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মী কারাগারে এবং লক্ষাধিক কর্মী মিথ্যা মামলার কারণে জীবনের ঝুঁকিতে ছিলেন। সে সময় প্রতিদিন অনলাইনে ও টকশোতে বক্তব্য দিয়ে তিনি নেতাকর্মীদের মনোবল জুগিয়েছেন এবং জাতির সামনে আশার আলো জাগিয়ে রেখেছেন।
৫ আগস্ট আন্দোলনের বিজয়ের পর শেখ হাসিনা ও ফ্যাসিস্ট শক্তির পতনে তিনি আনন্দিত হলেও কিছুদিনের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা ঘোষণা দেন, জামায়াত-শিবিরই ছিল জুলাই আন্দোলনের মূল ভ্যানগার্ড। ফজলুর রহমান দাবি করেন, সেদিন থেকেই আন্দোলনের বিজয়কে নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করতে শুরু করে জামায়াত-শিবির। তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ১৫ বছরের সংগ্রামের জমি প্রস্তুত করেছে বিএনপি, বীজ ও চারা রোপণ করেছে তারা, ধান ফলিয়েছে তারাই; অথচ ধান কাটার সময় ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সেটি নিয়ে নেয়। তার ভাষায়, এরা ‘দাওয়াল’।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, পরাজিত শক্তি জামায়াত-শিবির প্রকাশ্যে মাঠে নেমে দাবি করছে আন্দোলনের নেতৃত্ব তাদের। এমনকি তারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। জামায়াতের পত্রিকায় আহ্বান জানানো হয়, ‘৭১-এ যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল তারা আল্লাহর কাছে মাফ চাও। ’ এরপর থেকেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে সতর্ক করতে শুরু করেন।
তার দাবি, জামায়াত-শিবির ও এনসিপি একসাথে বলতে শুরু করে ১৯৪৭ হলো প্রথম স্বাধীনতা, ২০২৪ হলো দ্বিতীয় স্বাধীনতা আর ১৯৭১ কেবল ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এসব শুনে তার মনে হয়েছে, এ ধরনের অশ্রাব্য ও মিথ্যা তথ্য শোনার আগে মৃত্যু হওয়াই শ্রেয় ছিল। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সত্য তুলে ধরতে শুরু করেন এবং জামায়াত-শিবিরকে ‘কালো শক্তি’ ও এনসিপিকে তাদের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করেন।
ফজলুর রহমান বলেন, জনগণ এখন বুঝতে শুরু করেছে জুলাই আন্দোলনের দুটি রূপ ছিল—একটি বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী শক্তির নেতৃত্বে গণআন্দোলন, যার লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদী সরকারকে পরাজিত করে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা; অন্যটি জামায়াত-শিবিরের ষড়যন্ত্র, যারা আন্দোলনের ফসলকে কুক্ষিগত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি সৃষ্টি করছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। জিয়ার স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে কথা বলা নিজের পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করেন। গত ছয় মাসে শত শত বক্তব্য দিয়েছেন বলেও জানান তিনি। যদিও তার কোনো বক্তব্যে ভুল হয়ে থাকলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করতে প্রস্তুত।
এ ছাড়া তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পর স্বৈরাচারী সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি দেশের নানা স্থানে শত শত সভা ও জনসভায় বক্তব্য রেখেছেন। সাম্প্রতিক একটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অপমানজনক স্লোগান দেওয়ার ঘটনায়ও তিনি ইউটিউবে প্রথম কঠিন প্রতিবাদ জানান।
তার বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “আমার সার্বিক উপস্থাপনায় যদি প্রমাণিত হয় আমি কোনো ভুল করেছি, তবে আমি দুঃখ প্রকাশ করব। তবে বিএনপির ক্ষতি হয় এমন কিছু আমি করিনি, করবও না। দলের নেতৃত্বের বিচারের প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। আশা করি সুবিচার পাব এবং বৃহত্তর স্বার্থে সব সিদ্ধান্ত মেনে চলব। ”
ফজলুর রহমান আরও লেখেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধের মহান ঘোষক ‘মেজর জিয়া’ পরবর্তী সময়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দল। তার মহান স্মৃতিকে শ্রদ্ধা এবং স্মরণ করেই আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে নিরন্তর কথা বলা এবং প্রতিবাদ করাকে আমার পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করি। গত ৬ মাস ধরে এ ব্যাপারে আমি শত শত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছি, এর মধ্যে দু-একটা বক্তব্যে আমার কিছু ভুল-ত্রুটিও থাকতে পারে, কারণ আমি তো মানুষ। আমি আরো দাবি করতে চাই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার অন্যায়ভাবে কারাগারে নিক্ষেপ করার পরে আমি স্বৈরাচারী সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নেত্রীর মুক্তির জন্য সমগ্র বাংলাদেশে শত শত সভা ও জনসভায় বক্তব্য রেখেছি। এমনকি ইদানীংকালে একটি দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এমন জঘন্যতম কুৎসিত স্লোগান দিয়ে তাকে রাজনৈতিকভাবে অপমান করা হচ্ছিল যার উদাহরণ ‘গাছের ডালে কাউয়া’। তখন আমিই প্রথম ইউটিউব চ্যানেল পুর্নিয়াতে কঠিনভাবে এর বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলাম।