আর্কাইভ  সোমবার ● ২৭ অক্টোবর ২০২৫ ● ১২ কার্তিক ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ২৭ অক্টোবর ২০২৫
অবৈধ রাইডে ঝরছে শিশুপ্রাণ

রংপুর চিড়িয়াখানায় শিশু পার্ক
অবৈধ রাইডে ঝরছে শিশুপ্রাণ

৩ দিন পরই বাতিল হয়ে যাবে অতিরিক্ত সিম

৩ দিন পরই বাতিল হয়ে যাবে অতিরিক্ত সিম

দেশে ফের কমল স্বর্ণের দাম

দেশে ফের কমল স্বর্ণের দাম

‘জীবন থেকে পালাতে চেয়েছিলেন’ মেট্রো দুর্ঘটনায় নিহত আবুল কালাম

‘জীবন থেকে পালাতে চেয়েছিলেন’ মেট্রো দুর্ঘটনায় নিহত আবুল কালাম

রংপুর চিড়িয়াখানায় শিশু পার্ক

অবৈধ রাইডে ঝরছে শিশুপ্রাণ

সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫, দুপুর ১১:২৬

Advertisement

নিউজ ডেস্ক: রংপুর চিড়িয়াখানায় গড়ে তোলা শিশু পার্কে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেই, এমন বিদ্যুত্চালিত রাইড পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব রাইডের ধারেকাছে নিরাপত্তাবেষ্টনীও নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এবং নিবিড় তদারকি ছাড়াই সেগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলে এগুলো প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। চিড়িয়াখানায় আসা শিশু-কিশোররাও প্রতিনিয়ত থাকছে চরম ঝুঁকিতে।

গত শনিবার দুপুরে এই চিড়িয়াখানার ভেতরের শিশু পার্কে ‘চলন্ত ইলেকট্রিক ট্রেনে’র নিচে পড়ে লালমনিরহাট থেকে মা-বাবার সঙ্গে ঘুরতে আসা তিন বছরের কন্যাশিশুর প্রাণহানি ঘটেছে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, হাসপাতাল ও ইজারাদারের কাছেও শিশুটির পরিবারের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এই প্রাণহানির পর থেকে এখানে আসা দর্শনার্থীরা আতঙ্কে আছেন।

রংপুর চিড়িয়াখানা রংপুর মহানগরের হনুমানতলায় অবস্থিত। এটি ১৯৮৯ সালে ২১.৫১ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে। এক যুগ আগে চিড়িয়াখানার দক্ষিণ-পশ্চিমের কিছু অংশে বেষ্টনী দিয়ে চালু করা হয় শিশু পার্কটি। ঢাকার উত্তর মুগদার তারিখ হোসেন তুহিনের প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স এফএম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’কে এটি ইজারা দেওয়া হয়।

রংপুর জেলা প্রশাসনের বিনোদন পার্ক নীতিমালা অনুযায়ী, যেকোনো ইলেকট্রনিক রাইড চালানোর আগে প্রযুক্তিগত পরিদর্শন ও নিরাপত্তা যাচাই বাধ্যতামূলক।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষই বলছে, বিদ্যুত্চালিত এসব রাইড চালানোর জন্য প্রাণিসম্পদ কোনো অনুমোদনপত্র নেই। নিজেদের তৈরি করা শর্তে দরপত্র আহবান করে তা ঠিকাদারের মাধ্যমে পরিচালনা করা হচ্ছে। রংপুর চিড়িয়াখানার ইজারা নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘শিশু পার্কের অভ্যন্তরে বিদ্যুত্চালিত রাইড থাকায় দর্শনার্থী ও শিশুদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবিধানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় ইজারাদারকে নিতে হবে।’

এদিকে গত শনিবার দুপুরে রংপুর চিড়িয়াখানায় শিশুদের বিনোদনের জন্য রাখা ট্রেনের চাপায় তিন বছরের এক কন্যাশিশুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চারপাশ খোলা রেখে ট্রেন চালানোয়। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ শিশুটির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। গতকাল রবিবার পর্যন্ত তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। শিশুটিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, চিড়িয়াখানার শিশু পার্কের উত্তর পাশে দোলনায় খেলছিল শিশুটি। ওই সময় ট্রেনটি লাইনে চলছিল। শিশুটি ট্রেনের সামনে দৌড়ে গেলে ট্রেনের চাকা তার গলার ওপর দিয়ে চলে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে পাঠানো হয়। তবে বিভাগে পৌঁছানোর আগেই শিশুটির প্রাণহানি ঘটে। জরুরি বিভাগ থেকে শিশু সার্জারি বিভাগে পাঠানোর পর ভর্তি না হওয়ায় শিশুর কোনো তথ্য রেকর্ডে নেই। শিশুটিকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় চিড়িয়াখানার ঠিকাদারের লোকজনও ছিল। শিশুর মৃত্যু হলে তারা লাশ ও অভিভাবককে দ্রুত সরিয়ে নেন।

এই প্রাণহানির ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান রংপুর জেলা কৃত্রিম থেরিওজেনোলজিস্ট ড. মো. জোবাইদুল কবীর। এ ছাড়া কমিটিতে সদস্য আছেন সদর উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডা. বিকাশ রায় ও রংপুর চিড়িয়াখানার ভেটেরিনারি সার্জন ডা. এইচ এম শাহাদৎ।

গতকাল গিয়ে দেখা গেছে, রংপুর চিড়িয়াখানার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গড়ে ওঠা শিশু পার্কে রয়েছে ১০ আসনের ফাইটার প্লেন, ২৪ আসনের ডেঞ্জার রোলার বোট, ২০ আসনের স্পাইডার ক্রেডোল, চার বগির ইলেকট্রিক বুলেট ট্রেন, ভূতের ঘরসংসার ও তিন বগির রোলার কোস্টার। আছে অন্যান্য দোলনা, স্লাইড ও ঘূর্ণিচাকা। এসব রাইডে কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। শিশুদের জন্যও নেই নিরাপত্তাব্যবস্থা। সরাসরি বিদ্যুৎ সংযোগে চালিত হয় এগুলো। দেখা গেছে, ইলেকট্রিক বুলেট ট্রেনটি পুরনো ও মরিচা ধরা, ব্রেক করার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। একাধিক দোলনা অচল পড়ে আছে। এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পার্কের যন্ত্রপাতি অনেক পুরনো। ঠিকাদাররা বছরে একবার রং ও পলিশ করলেও ভেতরের স্ক্রুগুলো কেউ পরীক্ষা করে না। এমনকি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষও কখনো নজর দেয় না। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই বছরের পর বছর শিশুদের খেলতে দেওয়া হচ্ছে এসব সরঞ্জামে। এই পার্কে রংপুরের কাউনিয়া থেকে আসা আফজাল হোসেন বলেন, চিড়িয়াখানার ভেতরে শিশু পার্কের রাইডগুলোতে কোনো প্রশিক্ষিত অপারেটর বা নিরাপত্তাকর্মী থাকে না। বিদ্যুৎ চালু করেই শিশুদের ট্রেনে তোলা হয়, অথচ শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো ব্যবস্থা নেই। চিড়িয়াখানার মতো জনবহুল স্থানে শিশুদের জন্য নিরাপদ বিনোদন নিশ্চিত করা দরকার। একই এলাকার আনিছুর রহমান বলেন, প্রতিটি শিশু পার্কে ঝুঁকিপূর্ণ দোলনা বা সরঞ্জাম অবিলম্বে বন্ধ রাখতে হবে। চিড়িয়াখানায় পশুপাখির পাশাপাশি মানুষের জীবনকেও গুরুত্ব দিতে হবে। চিড়িয়াখানা আনন্দের জায়গা, শেখার জায়গা। কিন্তু সেই আনন্দ যদি মৃত্যু ডেকে আনে তাহলে সেটি মানবিক ও সামাজিক ব্যর্থতা। আজিজুল ইসলাম বলেন, শুনেছি শনিবার একটি শিশু মারা গেছে। এরপর ভয় লাগছে। বাচ্চা নিয়ে আসি প্রাণী দেখাতে, কিন্তু ওরা খেলতে চায় বলে বাধ্য হয়ে যাই শিশু পার্কে। অনেকবার দেখেছি দোলনাগুলো কাঁপে, স্ক্রু ঢিলা থাকে। কিন্তু কেউ তদারকি করে না।

রংপুর চিড়িয়াখানার কিউরেটর (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. ওমর ফারুক বলেন, চিড়িয়াখানার মূল লক্ষ্য প্রাণী সংরক্ষণ ও প্রদর্শন। শিশু পার্কগুলো বিনোদনের জন্য বেসরকারি অংশীদারিতে পরিচালিত হয়, দরপত্র আহবান করার পর সর্বোচ্চ দরতারাকে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এগুলো বসানোর কোনো নীতিমালা আমাদের কাছে নেই। আমরাই যখন কার্যাদেশ দিই তখন শর্ত দিয়ে দিই। সেই শর্ত অনুযায়ী রাইডগুলো পরিচালনা করে ইজারাদার। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেই দায় তাদের।’

ইলেকট্রিক রাইডে শিশুমৃত্যুর ঘটনাটি দুঃখজনক উল্লেখ করে ওমর ফারুক বলেন, শিশু পার্কের সরঞ্জামগুলো পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যত দিন নিরাপত্তা নিশ্চিত না হবে তত দিন ইলেকট্রিক ট্রেন চলবে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এফএম ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কোনো ব্যক্তিকেই পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত ফোন নম্বর থাকলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।

রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মজিদ আলী জানান, গত শনিবারের প্রাণহানির ঘটনায় কেউ অভিযোগ করেনি। তা পেলে অবশ্যই তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খবর-কালের কণ্ঠ

মন্তব্য করুন


Link copied