নিউজ ডেস্ক: আওয়ামী লীগ তিনবার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে ছোপ ছোপ রক্ত আর কাড়ি কাড়ি লাশ উপহার দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, তারা ১৯৯৬ সালে ‘আমরা ভালো হয়ে গেছি’ বলে ভোট চায়, এরপর মসনদে বসে নিজেদের রূপ দেখায়।
মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) বিজয় দিবস উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত ‘যুব ম্যারাথন’ শুরুর আগে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। সকাল ৮টার দিকে ম্যারাথনটি শুরু হয়ে রাজধানীর কাঁটাবন, সায়েন্সল্যাব, ধানমন্ডি হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে শেষ হয়।
জামায়াত আমির বলেন, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ মহান আল্লাহ তাআলার দান। পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বৈষম্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে অবিচার করার কারণে এদেশের মানুষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল। উনসত্তরের গণআন্দোলনের হাত ধরে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচনের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একগুঁয়েমির কারণে নির্বাচিত দল এবং জনপ্রতিনিধিরা, জনগণের ভোটের ম্যান্ডেটে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের রাজনৈতিক অধিকার পাননি। সেদিন পাকিস্তানি শাসকরা জনগণের ভোটের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে একটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এদেশের ছাত্র-শ্রমিক, কৃষক-জনতা এক কাতারে শামিল হয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
‘বুক ভরা আশা আর চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল যে প্রিয় দেশ সব ধরনের বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি পাবে। সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, দেশ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে, জাতি হিসেবে গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বিশ্বের বুকে আমরা চলাফেরা করতে পারব। যারা সেদিন নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা এমনটাই জাতিকে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ, যেই দেশটি বিপুল সংখ্যক মূল্যবান জীবন, সম্পদ আর ইজ্জতের ত্যাগের বিনিময় অর্জিত হয়েছিল, এ দেশে শাসকগোষ্ঠী জনগণের সঙ্গে দেওয়া কথা রাখেনি। তারা জাতিকে ভুলে গিয়ে একটি পরিবার-গোষ্ঠী এবং সর্বোচ্চ একটা দলকেই বাংলাদেশের মালিক এবং জমিদারে পরিণত করেছিলেন। বাকি সমস্ত মানুষকে তারা দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্র খতম করে দিয়েছিল। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। মানুষের বাঁচার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ভোটের অধিকারও তারা কেড়ে নিয়েছিল। এককথায় জনজীবনে মানুষ হিসেবে মানুষের যে সমস্ত মৌলিক ও মানবিক অধিকার আছে সবগুলো সেদিন দলিত হয়েছিল।’
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমাদের পুলিশ ছিল, সেনাবাহিনী ছিল, আধা-সামরিক বাহিনী ছিল, সাহায্যকারী আনসার ছিল; কিন্তু দল, গোষ্ঠী, পরিবারকে রক্ষা করার জন্য সেদিন একটি জল্লাদ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল, যার নাম ছিল রক্ষী বাহিনী। এই জল্লাদ বাহিনীর হাতে মানুষের জীবন, সম্পদ এবং ইজ্জতকে অবলীলায় তুলে দেওয়া হয়েছিল। যখন যাকে ইচ্ছা তাকে খুন করা হয়েছে। এ মানুষগুলোর সামান্যতম বিচার পাওয়ার কোনো অধিকার সেদিন ছিল না। মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা হয়েছে। সম্ভ্রমশীল পরিবারের লোকেরা তাদের মেয়েদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল। ঘর থেকে মা-বোনরা বের হতে চাইতেন না। এরকম একটা বিভীষিকাময় অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর ছেলেরা ব্যাংক ডাকাতিতে লিপ্ত হয়েছিল। বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিশ্ব থেকে এই বিধ্বস্ত অবস্থায় যে সমস্ত রিলিফ সামগ্রী এসেছিল, তা বাংলাদেশে আসার আগেই বিদেশের মাটিতে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে লাখো মানুষের লাশ সারা বাংলার হাটে, মাঠে, পথে, ঘাটে পড়ে থেকেছে দাবি করে তিনি বলেন, এই লাশগুলো দাফন করার মতো কোনো ব্যবস্থা সেদিন ভালোভাবে ছিল না। সেদিন আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম ঢাকার লাশগুলো দাফনের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সারা বাংলার চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা সোনার বাংলা গড়ার ওয়াদা করে বাংলাকে শ্মশান বাংলায় পরিণত করেছিল। মাত্র পৌনে চার বছরের দুঃশাসন মানুষকে তটস্থ করে তুলেছিল। এরপর তাদের কার্যক্রমের পরিণতি হিসেবে দুনিয়া থেকে তারা বিদায় নিয়েছিলেন। কে সেদিন তাদের হত্যা করেছিল; যারা একাত্তরের রণাঙ্গনে বুক চিতিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল, সেই সৈনিকরা কেন সেদিন ক্ষেপে গিয়েছিল? এর উত্তর আওয়ামী লীগকে খুঁজতে হবে; জাতিকে নয়।
“আমরা আশা করেছিলাম ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি থেকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল, একনায়কতন্ত্র কায়েম হয়েছিল, তা থেকে আওয়ামী লীগ শিক্ষা নেবে। কিন্তু ওই যে কথায় আছে—‘কয়লা ধুইলেও ময়লা যায় না’। সাবান আর সার্ফ এক্সেল যা দিয়েই ধৌত করেন না কেন, কালো কয়লা আরও কুচকুচে কালো হয়। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। তিন দফায় বাংলাদেশের মসনদে তারা (আওয়ামী লীগ) এসেছিল; ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি, আবার ১৯৯৬ সালের ১০ জানুয়ারি, আবার তারা ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০০৯ সালের ৭ জানুয়ারি। এই তিনবার তারা ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে ছোপ ছোপ রক্ত আর কাড়ি কাড়ি লাশ উপহার দিয়েছে।”
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগে হাতজোড় করে তারা জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়েছে—‘অতীতে আমাদের দল বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে যে অন্যায় আচরণ করেছে, যে জুলুম করেছে, আমরা বিনা শর্তে মাফ চাই। আমাদেরক আপনারা ক্ষমতায় দিন। আমরা ভালো হয়ে গেছি। এখন দেশের জন্য ভালো কিছু করতে চাই।’ হাতে তসবিহ ছিল। মাথায় ঘোমটা ছিল। জনগণ সহজ-সরলভাবে ধারণা করেছিল, তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু না। যখনই তারা মসনদে বসল, তারা আপন রূপে আত্মপ্রকাশ করল।
শেখ হাসিনার হুমকি-ধমকির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আপনাদের মনে থাকার কথা, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে গিয়ে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের নেতাদের তিরস্কার করে বলেছিলেন, ‘তোমরা কি হাতে চুড়ি পরে বসে আছো?’ তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আর যদি আমার দলের একটা মানুষকে হত্যা করা হয়, তাহলে তার বিনিময়ে ১০টা লাশ ফেলে দেব।’ এই ছিল একজন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বজ্ঞানহীন হুংকার-আস্ফালন। তারা তাই করেছিল। সেই সময়টা খালে, বিলে, নদীতে, নালায়, জঙ্গলে, হাটে, মাঠে, সর্বত্র মানুষের টুকরা টুকরা লাশ পাওয়া যেত। এরপরে জনগণের দ্বারা তারা প্রত্যাখ্যাত হলেন।
‘আবার অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর প্রকাশ্য দিবালোকে পল্টন মোড়ে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। এমনকি বিশ্ব বিবেক আর মানবতাকে লজ্জা দিয়ে সেদিন মাটিতে পড়ে যাওয়া মৃত শরীরের ওপর উঠে তারা লাফালাফি-নাচানাচি করেছিল। এরা কোন প্রজাতি! এরা কি আসলেই মানুষ প্রজাতির! পশুও এরকম আচরণ করে না। তারা তাই করেছিলেন। সেদিন টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা শিশুরা নাকি চিৎকার দিয়ে অনেকে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। দেশ-বিদেশ থেকে ধিক্কার জানানো হয়েছিল। কিন্তু না, তারা এর মধ্য দিয়ে জানান দিয়েছিল, আগামীতে ছলে বলে কৌশলে আমরা ক্ষমতায় যাবই। আমরা ক্ষমতায় গিয়ে যা করব আজকে তার একটা রিহার্সাল বিশ্ববাসীকে দেখালাম। সেই তারা ক্ষমতায় এসে বিডিআরের পিলখানায় হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যে খুনের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন, আমরা তার বীভৎস চেহারা শাপলা চত্বরে দেখেছি। আমরা বাংলাদেশের সর্বত্র দেখেছি, এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে তাদের হাতে মানুষ খুন হয়নি। যেখানে তাদের হাতে আমাদের মায়েদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়নি।’
ধানের শীষে ভোট দেওয়ার কারণে নোয়াখালীতে এক গৃহবধূকে আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের প্রসঙ্গ টেনে জামায়াত আমির বলেন, একটা প্রতীকে ভোট দেওয়ার অপরাধে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে আমার একজন মায়ের কী অবস্থা হয়েছিল! ১৮ কোটি মানুষ তার সাক্ষী। ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর সেই পরিবারে গিয়েছিলাম। ওদের কথা শুনে আমরা আমাদের বুক সামলাতে পারিনি। এই যে খুন-দর্শন, আয়নাঘর আর ঘুমের রাজনীতি শুরু হলো, শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি বরণ করে তারা ৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গেল। বেশিরভাগ পালিয়ে গিয়ে এদেশের মানুষকে কি শান্তি দিচ্ছে? সর্বশেষ ঘটনা, আমাদের ভাই শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর গত জুমাবার প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে তার জীবনটা শেষ করে দিতে চেয়েছে। সে এখন জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে আছে।
‘আজকে যুব ম্যারাথন এ কথাই দেশ ও বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য যে, অতীতের বস্তাপচা সমস্ত রাজনীতিকে পায়ের তলে ফেলে দিতে চাই। এই রাজনীতি বাংলাদেশে অচল। এই রাজনীতির পাহারাদারি যারা করবে, তারা অচল মালে পরিণত হবে। এখন বাংলাদেশের নতুন রাজনীতি করতে হবে। যে রাজনীতি হবে দেশ, জাতি, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের পক্ষে। যে রাজনীতি হবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পক্ষে। যে রাজনীতি হবে দুর্নীতির বিপক্ষে। যে রাজনীতি হবে চাঁদাবাজ, দখলবাজ, মামলাবাজ ও ধর্ষণকারীদের বিপক্ষে।’
তিনি বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি, আমরা আমাদের দলের বিজয় চাই না। আমরা চাচ্ছি ১৮ কোটি মানুষের বিজয়। এই বিজয় হবে আমাদের দলের বিজয়। ১৮ কোটি মানুষের বিজয় হিসেবে যা চিহ্নিত হবে, সেই বিজয়ের আমরা অংশীদার হব। এই বিজয়ের পথে বাধার যত দেয়াল তুলে দেওয়া হবে এই যুবকরা লাথি মেরে সমস্ত দেয়াল ভেঙে চুরমার করে দেবে। কোনো দেয়াল আমরা টিকতে দেব না। কোনো ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না। কেউ যেন নিজেকে অতিরিক্ত ধূর্ত না ভাবেন। জনগণ এখন তার নিজের বুঝটা বুঝতে শিখেছে। কাউকে আর ছাড় দেওয়া হবে না। কোনো কালো হাত সামনের দিকে এগিয়ে এলে সেই কালো হাত জনগণ অবশ করে দেবে। কালো টাকার বিনিময়ে মানুষকে কেনার দুঃসাহস দেখালে তাদের মুখে ছাই মেরে দেওয়া হবে।
‘আগামীতে যে নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ অনুষ্ঠিত হবে, সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাসের মোড়ক উন্মোচন হবে, ইনশাআল্লাহ। এই নির্বাচনে যুবক-যুবা, তরুণ-তরুণী, প্রাপ্তবয়স্ক, এবং যারা দেশ-বিদেশের ভোটার, তাদের ভোট নিয়ে কেউ যেন কোনো কারিগরি করার বা ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা না করেন। জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে কোনো ষড়যন্ত্র থাকলে সবকিছু ভেসে যাবে’, যোগ করেন জামায়াত আমির।
প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের ওপর রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সেই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করুন। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য এখন নির্বাচন কমিশনকে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। আমরা তাদের কাছে কোনো আনুকূল্য চাই না। কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি, যদি কারও প্রতি সামান্য কোনো আনুকূল্য দেখানো-দেওয়া হয়, তা বরদাশত করা হবে না। আমরা চাই আপনারা আপনাদের শপথের আলোকে নিরপেক্ষভাবে সে দায়িত্ব পালন করুন। জনগণ যাদের তাদের ভালোবাসা, সমর্থন এবং ভোট দিয়ে বরণ করে নেবে, আমরাও তাদেরকে বরণ করে নেব, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু জনগণের ভালোবাসাকে অপমানিত করে, উপেক্ষা করে বাঁকা রাস্তায় কেউ চলতে চাইলে সেই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।