আবির ইলাহি জুবায়ের: রংপুর শহরের খামাড় মোড়—এ জায়গাটিকে অনেকেই শহরের ‘টিএসসি’ বলে ডাকেন। কারণ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে এখানে গড়ে উঠেছে এক অনন্য আড্ডা-সংস্কৃতি। কারমাইকেল কলেজ কিংবা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থীর গল্প, হাসি, তর্ক আর স্মৃতির সঙ্গে মিশে আছে এই মোড়ের প্রতিটি ইট। আর এই পুরো পরিবেশকে আরো বেশি প্রাণবন্ত করে রেখেছেন একজন মানুষ—**এরশাদ মামা**। তার দোকানের বিশেষ আকর্ষণ **দুধ প্যাডিস আর চা** যেন খামাড় মোড়ের পরিচয়ের অংশ হয়ে গেছে।
চায়ের দোকান—শব্দ দুটি শুনলেই এক ধরনের পরিচিত গন্ধ ভেসে আসে; ধোঁয়া, চা, শব্দ আর মানুষের রঙিন ভিড়। কিন্তু এরশাদ মামার দোকান শুধু এই গন্ধেই সীমাবদ্ধ নয়। দোকানে ঢুকলেই প্রথমে চোখে পড়ে একটি বড় পাত্র, যেখানে ফুটছে দুধ প্যাডিস—দুধ, চিনি আর প্যাডিসের ঘন মিশ্রণ, যা রংপুরের বিশেষ পানীয় হিসেবে এখন পরিচিত। কেউ কেউ এটাকে জ্বাল দেওয়া ক্ষীর বলে, কেউ বলে স্পেশাল মিল্ক-ড্রিংক; কিন্তু সবাই জানে—এটার স্বাদ ঠিক ‘এরশাদ মামার দোকানের’ স্বাদ। আর এই স্বাদতে মিশে থাকে মামার হাসি আর আন্তরিকতা।
সন্ধ্যার আগে দোকানে চা বা দুধ প্যাডিস খেতে গেলে সাধারণত শান্ত পরিবেশ দেখা যায়। কিন্তু সূর্য ঢলতে না ঢলতেই মোড়জুড়ে যেন ঢেউয়ের মতো মানুষ নেমে আসে। ছাত্রছাত্রী, স্থানীয় মানুষ, কর্মজীবী, রিকশাওয়ালা—কারো ভিড়েই কমতি নেই। সবাই জানে, দিন শেষ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এরশাদ মামার দোকানে থেমে যাওয়া। এক কাপ চা কিংবা আধা গ্লাস দুধ প্যাডিস—মানুষের ক্লান্তি ধুয়ে দেওয়ার জাদুই যেন।
বেরোবির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিফাত বলে, “দেখেন ভাই, চা তো অনেক জায়গাতেই পাই। কিন্তু মামার দুধ প্যাডিস—এটা খাইলে মাথা ঠান্ডা হয়ে যায়। ক্লাসে মন বসে না, অ্যাসাইনমেন্টের চাপ, সব ভুলে যাই এখানে এসে।” একইভাবে করমাইকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিথিলা বলেন, “আমরা বান্ধবীরা প্রায়ই এখানে বসি। শুধু চা না, এই দোকানে একটা অন্যরকম আরাম আছে।”
এই দোকানটির সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো আড্ডা। কত গল্প যে জন্ম নেয় প্রতিদিন! কোথাও ছাত্ররাজনীতি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা, কোথাও ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়ে হাসিঠাট্টা, আবার কোথাও প্রেম-বিরহের দুঃখের গল্প। এর প্রতিটাই যেন দোকানের টিনের চালে আজো লেগে আছে। এরশাদ মামা বলেন, “এই মোড়ের গল্প শেষ হইব না। যে কয়টা বাচ্চা আসে, তারা আমার নিজের মতো। সুখ-দুঃখ সবই শোনাইতে আসে।” সত্যিই, মামার দোকান যেন খামাড় মোড়ের ‘কাউন্সেলিং কর্নার’।
এরশাদ মামা বছরের পর বছর ধরে এই দোকান চালাচ্ছেন। চোখ-মুখে একরাশ শান্তি। তার প্রশস্ত হাসি দোকানে আসা মানুষের প্রথম স্বাগত। তিনি বলেন, “আমি সকালে দোকান খুলাই, আর রাত ২-৩টা পর্যন্ত থাকি। কিন্তু ক্লান্তি লাগে না। এতগুলো চেনা মুখ, এত কথা—সব মিলিয়ে দোকানই আমার পরিবার।” শিক্ষার্থীদের প্রতিও তিনি বিশেষ স্নেহশীল। কে কোন বিষয়ে পড়ে, কার পরীক্ষা কবে—মামার কাছে অজানা নয়।
দোকানে চায়ের পাশাপাশি দুধ প্যাডিসের যে জনপ্রিয়তা, তার কারণ শুধু স্বাদ না; এর সঙ্গে জড়িত মানুষের অনুভূতি। শীতের রাতে উনুনের ধারে দাঁড়িয়ে গরম প্যাডিস হাতে নেওয়ার মুহূর্তটা যেন নিজেকে আবার নতুন করে পাওয়ার মতো। অনেকেই বলেন, “এরশাদ মামার প্যাডিস না খেলে শীতের রাত অসম্পূর্ণ।” আড্ডা, গল্প, হাসি আর কোলাহলের মাঝে এই গরম দুধ প্যাডিস যেন আলাদা এক শান্তি।
খামাড় মোড়কে অনেকে রংপুরের সামাজিক কেন্দ্রও বলে থাকেন। নতুন মানুষ পরিচিত হয়, পুরনো বন্ধুরা মিলিত হয়। কোনো ছাত্রের হোস্টেল সমস্যা হোক, কোনো ক্লাবের ইভেন্টের পরিকল্পনা হোক, বা কোনো গবেষণার বই খোঁজ—সবকিছুর আলোচনা হয় এখানেই। শহরের ব্যস্ত জীবনে এ যেন এক উন্মুক্ত সামাজিক মঞ্চ।
কেউ কেউ বলে, রংপুরে আধুনিক ক্যাফে যতই হোক, খামাড় মোড়ের এই দোকানগুলোর স্বাদ কখনো বদলায় না। কারণ এখানে আসে মানুষ গল্প বলতে, বন্ধু খুঁজতে, নিজের ভাবনা ভাগ করতে। এরশাদ মামার দোকান সেই গল্পের কেন্দ্র, আর তার দুধ প্যাডিস যেন এই পুরো পরিবেশের হৃদস্পন্দন।
বছর চলে বছর আসে। নতুন শিক্ষার্থীর দল আসে, পুরনোরা চলে যায়। কেউ চাকরি পায়, কেউ শহর ছেড়ে অন্য কোথাও গড়ে তোলে জীবন। কিন্তু যখনই তারা রংপুরে ফেরে, প্রথমেই খোঁজ করে খামাড় মোড় আর এরশাদ মামাকে। “মামা, একটা প্যাডিস দেন”—এই familiar ডাক যেন তাদের কৈশোর ফিরিয়ে আনে।
শেষ পর্যন্ত বলতেই হয়—এরশাদ মামার দুধ প্যাডিস এবং চা শুধু একটি পানীয় নয়; এটি রংপুরের তারুণ্যের স্মৃতি, প্রাণ, গল্প আর সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। মোড়জুড়ে যে কোলাহল, হাসি আর মানুষের জমাট ভিড়—তার কেন্দ্রবিন্দুতেই দাঁড়িয়ে থাকেন এরশাদ মামা। তার সরলতা আর চায়ের দোকান যেন খামাড় মোড়কে করে তুলেছে আরও মানবিক, আরও উষ্ণ, আরও জীবন্ত।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।