আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ২০ নভেম্বর ২০২৫ ● ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ২০ নভেম্বর ২০২৫

ডাকেই ফেরত আসুক গণতন্ত্র: বাংলাদেশে পোস্টাল ভোটের সম্ভাবনা

বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, রাত ১০:১১

Advertisement

আফিয়া ইবনাত লিথি 
আধুনিক গণতন্ত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক মাধ্যম হলো ভোট। একটি ব্যালট—একজন নাগরিকের মত, মূল্যবোধ ও রাষ্ট্রদর্শনের প্রতিফলন। কিন্তু ভোট দেওয়ার জন্য শারীরিকভাবে কেন্দ্র পর্যন্ত উপস্থিত হতে না পারলে নাগরিকের অধিকারটি আংশিক হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে বিশ্বজুড়ে পোস্টাল ভোট উচ্চারিত হচ্ছে নতুন সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে আলোচনা বাড়ছে—বিশেষ করে প্রবাসী নাগরিক, বয়স্ক ভোটার এবং বিভিন্ন সীমাবদ্ধতায় ভোগা মানুষের জন্য।
 
পোস্টাল ভোট হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে ভোটার নিজে কেন্দ্র পর্যন্ত উপস্থিত না থেকেও ডাকযোগে ভোট প্রদান করেন। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ভোটার আবেদন করলে তাকে ডাক বিভাগ ব্যালট পাঠায়। ভোটার ব্যালট পূরণ করে আবার ডাকবাক্সে ফেলে দেন, যা নিরাপদ খামে নির্বাচন কমিশনের হাতে পৌঁছায়। সারা পৃথিবীতে বহু বছর ধরেই এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে এটি সাধারণ ভোটারদের জন্যও চালু আছে। সেখানে পোস্টাল ভোট গণতন্ত্রকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপ দিয়েছে—যেখানে কেউ দূরত্ব, ব্যস্ততা বা শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হন না।
 
বাংলাদেশে পোস্টাল ভোট বর্তমানে সীমাবদ্ধ কিছু নির্দিষ্ট পেশাজীবী, যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের জন্য। কিন্তু প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশির কথা বিবেচনা করলে দেখা যায়—এখানে সম্ভাবনার ক্ষেত্র কত বিশাল। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা এই মানুষগুলো ভোট দিতে চান, কিন্তু কর্মস্থল ও দূরত্বের কারণে তা সম্ভব হয় না। পোস্টাল ভোট হলে তারা সহজেই বিদেশে বসে তাদের নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
 
দেশের ভেতরেও রয়েছে অনেক বয়স্ক, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, কিংবা দূরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা যারা পরিবহন সমস্যা বা শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন না। পোস্টাল ভোট তাদের জন্য একটি আশীর্বাদ হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রেও সামাজিক অস্বস্তি, নিরাপত্তাহীনতা বা পারিবারিক বাধা অনেক সময় ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতিকে জটিল করে তোলে। ঘরে বসেই ব্যালট পাঠাতে পারলে নারী ভোটারের অংশগ্রহণ বাড়বে ব্যাপকভাবে।
 
উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, পোস্টাল ভোট চালু হলে ভোটার উপস্থিতির হার বেড়ে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই প্রত্যাশা করা যায়। নির্বাচনের দিনে কেন্দ্র দখল, ধাক্কাধাক্কি, ভিড়ের কারণে শারীরিক সমস্যা—এসব ঝুঁকি থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে। ফলে নির্বাচন আরও শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অংশগ্রহণমূলক হবে।
 
যদিও সম্ভাবনা বড়, তবু বাস্তব চ্যালেঞ্জও কম নয়। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সক্ষমতা এখনো পুরোপুরি আধুনিক নয়। ব্যালট পাঠানো ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ, বিলম্ব, কিংবা হারানো–এর মতো সমস্যার ঝুঁকি থেকে যায়। পোস্টাল ভোট সফল করতে হলে প্রথম শর্তই হলো ডাক বিভাগকে দ্রুত, ট্র্যাকযোগ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর করা।
 
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ নিরাপত্তা। ডাকযোগে আসা ব্যালট যেন জালিয়াতি, কারসাজি বা বদলানোর ঝুঁকিতে না পড়ে—তা নিশ্চিত করতে হবে কঠোর আইনি কাঠামো দিয়ে। ব্যালটের গোপনীয়তা রক্ষাও একটি বড় বিষয়। এছাড়া দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে অবিশ্বাস, অনাস্থা বা পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ থাকলে পোস্টাল ভোট নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতে পারে। তাই সব পক্ষের আস্থা অর্জন না করলে পদ্ধতিটি কার্যকর হবে না।
 
প্রশাসনিক ব্যয়ও একটি বিবেচ্য বিষয়। নিরাপদ খাম, QR কোড, ট্র্যাকিং সিস্টেম, বায়োমেট্রিক যাচাই, কর্মী প্রশিক্ষণ—সব মিলিয়ে প্রাথমিক বিনিয়োগ বড় হবে। তবে এটি একবার চালু হলে দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের জন্য তা হবে একটি স্থায়ী অর্জন।
 
বাংলাদেশে পোস্টাল ভোট চালুর জন্য ধীরে ধীরে পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রথমে স্বল্পপরিসরে পাইলট প্রকল্প দিয়ে কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে—কিছু নির্বাচনি এলাকা বা বিশেষ পেশাজীবী গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে বাস্তব সমস্যাগুলো বোঝা যাবে।
 
ডাক বিভাগকে আধুনিক করতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থায়। ব্যালটের প্রতিটি ধাপ যেন ডিজিটালি ট্র্যাক করা যায়—এটি সবচেয়ে জরুরি। বায়োমেট্রিক যাচাই বা স্মার্ট এনআইডি সংযুক্ত ব্যবস্থা ব্যবহার করলে ব্যালটের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ কমবে।
 
প্রবাসী ভোটারদের জন্য আলাদা অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্ল্যাটফর্ম এবং বিশেষ নিরাপদ ডাকপথ তৈরি করা যেতে পারে। পাশাপাশি আইনি কাঠামোতে কঠোর শাস্তি, জবাবদিহি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
 
সবশেষে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে আলোচনার মাধ্যমে পোস্টাল ভোটের রূপরেখা তৈরি করাই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত পথ। আস্থা ছাড়া কোনো পদ্ধতিই গণতন্ত্রে টিকে থাকতে পারে না।
 
পোস্টাল ভোট শুধু ব্যালট পাঠানোর একটি পদ্ধতি নয়; এটি গণতন্ত্রকে আরও মানবিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং যুগোপযোগী করে তোলার একটি সেতুবন্ধন। বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে প্রবাসীদের সংখ্যা বিশাল, যেখানে পরিবহন ও শারীরিক সীমাবদ্ধতা প্রচুর, সেখানে পোস্টাল ভোট হতে পারে গণতান্ত্রিক নবযাত্রার সূচনা।
 
একটি ভোট—নাগরিকের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। সেটি ব্যবহার করার সুযোগ যত বেশি বিস্তৃত হবে, দেশ তত বেশি গণতান্ত্রিক হবে। সময় এসেছে ডাকযোগে সেই সুযোগ ফিরিয়ে আনার।
 
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

মন্তব্য করুন


Link copied