নিউজ ডেস্ক: দেশের স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দূর করা এবং জনগণের দোরগোড়ায় মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ৩২টি সুপারিশ-সংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এতে নাগরিকদের বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা, অতিদরিদ্র ২০ শতাংশ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান, স্বতন্ত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠন, স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক বিদ্যমান আইন সংস্কার ও নতুন আইন প্রণয়ন, দুর্গম এলাকায় কর্মরত চিকিৎসকদের প্রণোদনা, অন্তত ১০ মিনিট সময় নিয়ে রোগী দেখা, ওষুধ কোম্পানি থেকে চিকিৎসকদের উপহার ও হাসপাতালে চিকিৎসকদের সঙ্গে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা বাড়ানো এবং সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা ফার্মেসি চালু রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ রয়েছে।
গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক একে আজাদ খান। এ সময় সুপারিশগুলো পর্যালোচনার পর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নেন অধ্যাপক একে আজাদ খান।
গত বছরের নভেম্বর মাসে ১২ সদস্যবিশিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল সরকার। এতে সদস্য হিসেবে রয়েছেনÑ কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি ড. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন, পথিকৃৎ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর লিয়াকত আলী, গাইনোকলজিস্ট প্রফেসর ডা. সায়েবা আক্তার, শিশু স্নায়ুতন্ত্র বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. নায়লা জামান খান, সাবেক সচিব এমএম রেজা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক, আইসিডিডিআর’বির কনসালটেন্ট ডা. আজহারুল ইসলাম. স্কয়ার হাসপাতালের প্রফেসর ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, গ্রিন লাইফ সেন্টার ফর রিউম্যাটিক কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চের চিফ কনসালটেন্ট প্রফেসর ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, আইসিডিডিআর’বির বিজ্ঞানী, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের ডা. আহমদ এহসানুর রাহমান এবং ছাত্র প্রতিনিধি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী উমাইর আফিফ।
প্রতিবেদনে সাংবিধানিক অধিকার ও নতুন আইনের বিষয়ে প্রস্তাবে বলা হয়Ñ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। শুধু অন্তর্ভুক্তিই নয়, এই অধিকার যাতে বাস্তবায়ন করা যায়, সে জন্য ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা আইন’ প্রণয়নেরও প্রস্তাব করা হয়। এই আইন নাগরিকদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব নির্ধারণ করবে।
স্বাস্থ্য খাতে ন্যায্যতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন আইন’, ‘বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস আইন’, ‘জনস্বাস্থ্য ও অবকাঠামো আইন’, ‘বাংলাদেশ সেফ ফুড, ড্রাগ, আইভিডি ও মেডিক্যাল ডিভাইস আইন’, ‘ওষুধের মূল্য নির্ধারণ ও প্রাপ্তি আইন’, ‘স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও রোগী নিরাপত্তা আইন’সহ মোট ১৫টি নতুন আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়াও বিদ্যমান আইন, যেমনÑ‘বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন’, ‘নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন’ ইত্যাদি সংশোধনের সুপারিশ করা হয়।
লিখিত প্রতিবেদন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ শহীদ বীরদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করে বলা হয়, একটি বৈষম্যহীন ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাদের স্বপ্নের সহায়ক হোক এই স্বাস্থ্য খাত সংস্কার প্রস্তাব। প্রস্তাবের ভূমিকায় বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পরবর্তী দশকগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
স্বতন্ত্র পিএসসি গঠন : সুপারিশে স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতি প্রণয়নে সংসদ ও সরকারকে পরামর্শ দিতে একটি স্বাধীন ও স্থায়ী ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। পেশাদার, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস (বিএইচএস) নামে একটি নতুন সিভিল সার্ভিস গঠনের সুপারিশ করা হয়। এ জন্য স্বাস্থ্য খাতের নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে স্বতন্ত্র ‘পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য)’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া সংস্কার কমিশন স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে।
সেবার মান ও প্রাপ্যতা : প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে (ক্ষেত্রবিশেষে ভর্তুকি মূল্যে) প্রদান করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে সেকেন্ডারি স্বাস্থ্যসেবা জোরদার এবং জেলা হাসপাতালগুলোতে বিশেষায়িত (টারশিয়ারি স্তরের) চিকিৎসা চালু করা প্রয়োজন। প্রতিটি বিভাগীয় সদরে বিশ্বমানের টারশিয়ারি সেবা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। প্রতি রোগীর জন্য গড়ে ১০ মিনিটের পরামর্শ সময় নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের ২০ শতাংশ অতিদরিদ্র নাগরিকের জন্য সব হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবা প্রদানের সুপারিশ।
ওষুধ ও জরুরি সেবা : অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সর্বজনীন প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সরকারি ওষুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকায়ন ও বেসরকারি খাত থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে অ্যান্টি-ক্যানসার, অ্যান্টি-ডায়াবেটিক, অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ও অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর ভ্যাট এবং অন্যান্য শুল্ক ও কর শূন্য করার সুপারিশ করা হয়েছে। ভিটামিন, মিনারেলস, ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট ও প্রোবায়োটিকের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। জরুরি চিকিৎসাকে বিশেষায়িত ও অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
নেটওয়ার্ক ও অভিযোগ নিষ্পত্তি : জাতীয় ফার্মেসি নেটওয়ার্ক, জাতীয় ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক, জাতীয় রক্ত সঞ্চালন নেটওয়ার্ক এবং জাতীয় অ্যাম্বুলেন্স নেটওয়ার্ক গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেবাগ্রহীতার অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ডিজিটাল অভিযোগ নিষ্পত্তি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
প্রেস ব্রিফিং : প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কমিশনের প্রধান অধ্যাপক একে আজাদ খান বলেন, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা তদারকি করবে। তিনি জানান, কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জবাবদিহিতার আওতাভুক্ত থাকবে এবং ১৭টি বিভাগের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
কমিশনের সদস্য ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন কমিশনের প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার আনার জন্য তারা যে সব সুপারিশ করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং জনগণকে বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবার পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করেছি।’
কমিশনের সদস্য ডা. আবু মোহাম্মাদ জাকির হোসেন বলেন, রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে আইডিসিআরকে শক্তিশালী করার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। তারা যাতে সব সময় সতর্ক থাকতে পারে। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর করার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে তারা রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করতে পারে। এ জন্য জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার, সেগুলো নিতে হবে। তিনি বলেন, স্কুল হেলথে জোর দিয়েছি, যাতে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে রোগ প্রতিরোধ কীভাবে করা যায়। তারা বুঝলে এই ম্যাসেজটা বাড়িতে অন্যদের কাছেও পৌঁছে যাবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী, অধ্যাপক ডা. সায়েরা আক্তার, এমএম রেজা, ডা. আজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ আহসানুর রহমান এবং উমাইর আফিফ।