আর্কাইভ  সোমবার ● ১৪ জুলাই ২০২৫ ● ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ১৪ জুলাই ২০২৫
চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার

জুলাইয়ের দিনগুলি: ১৩ জুলাই

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
জুলাইয়ের দিনগুলি: ১৩ জুলাই

সারা দেশের সঙ্গে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
সারা দেশের সঙ্গে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা

সারা দেশ উত্তাল ছিল ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
সারা দেশ উত্তাল ছিল ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: বাংলাদেশের সমস্যা ও সম্ভাবনা

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর ২০২১, রাত ০৮:১৫

Advertisement

শেখ মাজেদুল হক

শিল্প বিপ্লব (বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়করণ , উন্নত যোগাযোগ এবং স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরুপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরী করার জন্য বড় আকারে মেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (এমটুএম) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) কে একসাথে করা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাইকার আলিবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় Housing প্রোভাইডার AIRBNB নিজেদের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই।’ কথাগুলো টম গুডউইনের। বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বোঝানোর জন্য টম গুডউইনের এই বাক্যগুচ্ছের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এমন কিছু, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। অপরিচিত মোটরসাইকেল চালকের পেছনে বসে আমাদের যাত্রীরা যাতায়াত করেন, কেনাকাটায় রকেট-বিকাশ এখন অনেকের সঙ্গী, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাস্তব’ নির্বাচনে সবচেয়ে প্রভাব ফেলেছে ‘ভার্চ্যুয়াল ফেসবুক’। এসবই সম্ভব হচ্ছে কারণ বাস্তব আর ভার্চ্যুয়াল জগৎ একাকার হয়ে যাচ্ছে।

গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ঘরের লাইট জ্বলে উঠলো, লিফট ওপেন হতেই ঘরের দরজা খুলে গেল, বাইরের ভ্যাপসা গরমের সাথে মানানসই তাপমাত্রায় ঘরের এসি চলতে শুরু করলো। ইন্টারনেট অফ থিংস এর যুগে এই ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা খুঁজতে যে কবিরাজ ধরতে হয় না সেটা আমরা ইতোমধ্যে জানি। এবার ভাবুন আপনার ফ্যাক্টরীর একটি স্যুবট (সেলাই করার রোবট) নষ্ট হওয়ার আগেই আপনাকে মেরামতের জন্য সিগন্যাল দিল অথবা রোবটটি কখন মেরামতের দরকার পড়লো আর কখন মেরামত করা হল সেটা আপনার জানার প্রয়োজনই পড়ল না, কারণ মেরামতের জন্য আলাদা রোবট নিযুক্ত আছে। এইযে মেশিনের সঙ্গে মেশিনের, সিস্টেমের সঙ্গে সিস্টেমের এবং সিস্টেমের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ, এরই নাম ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি)।

 

"চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া।" আজকের যুগের ডিজিটাল বিপ্লব, যাকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটির উৎপত্তি ২০১১ সালে, জার্মান সরকারের একটি হাই টেক প্রকল্প থেকে। একে সর্বপ্রথম বৃহৎ পরিসরে তুলে নিয়ে আসেন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান ক্লস শোয়াব। ইন্টারনেটের আর্বিভাবে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের পর তথ্যপ্রযুক্তির বাধাহীন ব্যবহার ও দ্রুত তথ্য স্থানান্তরের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের জীবন প্রবাহের গতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্টারনেট অব থিংকিং (আইওটি) ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়বে যেটি কিনা মানব সম্পদের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে। এই ডিজিটাল বিপ্লবের ছোয়ায় উৎপাদন ব্যবস্থার ঘটবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। যেখানে উৎপাদনের জন্য মানুষকে যন্ত্র চালাতে হবেনা, বরং যন্ত্র সয়ংক্রীয়ভাবে কর্ম সম্পাদন করবে এবং এর কাজ হবে আরও নিখুঁত ও নির্ভূল।চিকিৎসা, যোগাযোগ, প্রকাশনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও এর প্রভাব হবে অত্যন্ত জোরালো। বাংলাদেশে এই বিপ্লবের সুযোগ গ্রহন করতে হলে আগাম ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আইওটি,ব্লকচেইন ও রোবটিক্স ইত্যাদির ব্যবহার করতে দ্রুত কৌশলগত পরিকল্পনা করতে হবে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য হতে হবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী সুদক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি, আর এজন্য প্রয়োজন হবে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। বাংলাদেশে বর্তমানে তরুণের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৬ লাখ যা মোট জনসংখ্যার ৩০%। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগামী ৩০ বছর জুড়ে তরুণ বা উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। বাংলাদেশের জন্য ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করার এটাই সব থেকে বড় হাতিয়ার। জ্ঞানভিত্তিক এই শিল্প বিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ মানবসম্পদই হবে বেশি মূল্যবান। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষ চাকরি হারালেও এর বিপরীতে সৃষ্টি হবে নতুন ধারার নানাবিধ কর্মক্ষেত্র। এই বিপ্লবের ফলে দেশের মানুষের আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে জীবন মান বাড়বে। এছাড়া মানুষ তার জীবনকে বেশি মাত্রায় প্রযুক্তি নির্ভর করবে।আমদানি - রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ থেকে সহজতর হবে। ফলে বর্হিবিশ্বের আধুনিক জীবন ও জীবিকার উপকরণ দ্রুত পৌঁছে যাবে মানুষের হাতে। দেশে বর্তমানে সাড়ে ছয় লাখের বেশি তরুণ তরুণী অনলাইনে কাজ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। দেশিয় হার্ডওয়ার, সফটওয়্যার রপ্তানির হার দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং এর বাজার সামনে আরো বিস্তৃত হবে। অনলাইন প্লাটফর্মকে পুঁজি করে কর্মসংস্থানকারীদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গী করতে দেশের সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতাকে আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশের নির্মিত ও নির্মাণাধীন হাইটেক পার্কগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। তবে এই বিপ্লবের ফলে গোটা দুনিয়ার একটি বিশাল অঙ্কের মানুষের কাজ হারানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। এর প্রভাব আমাদের দেশেও অতি মাত্রায় লক্ষণীয় হতে পারে। মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়গুলোও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সমাজে বৈষম্য তৈরি করতে পারে। যেমন ‘কম-দক্ষতা স্বল্প-বেতন’ বনাম ‘উচ্চ-দক্ষতা উন্নত-বেতন’ কাঠামো অর্থনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেজ্ঞ মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তির মধ্যে অব্যাহত যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি যন্ত্রগুলো আপডেট করার পাশাপাশি প্রযুক্তির নিরাপত্তা ঝুঁকি আপডেটের মাঝে সমন্বয় সাধনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা আছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লক চেইন, আইওটি, ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবটিকস, মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইনের মত ক্ষেত্রগুলোতে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে নেতৃত্ব দিতে সবাইকে এক সাথে উদ্ভাবনের পথে একযোগে কাজ করতে হবে, তাহলেই আমরা এগিয়ে যাব। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার, বিদ্যুতের ব্যবহার এবং ট্রানজিস্টার আবিষ্কার ব্যাপক শিল্পায়ন সৃষ্টির মাধ্যমে মানবসভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছিল বলে ওই তিন ঘটনাকে তিনটি শিল্পবিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখন বলা হচ্ছে, ডিজিটাল প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবনের পথ ধরে আসছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, যেখানে বহু প্রযুক্তির এক ফিউশনে ভৌতজগৎ, ডিজিটালজগৎ আর জীবজগত পরস্পরের মধ্যে লীন হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বমানের সুযোগ সুবিধা নিয়ে দেশে ৩৯টি হাই টেক পার্ক করা হয়েছে। এসব পার্কে বিনিয়োগে কর অব্যাহতি, বিদেশিদের জন্য শতভাগ মালিকানার নিশ্চয়তা, আয়কর অব্যাহতিসহ নানা সুযোগ রাখা হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অনেক ধরণের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যারা ফ্যাক্টরি বা তথ্য প্রযুক্তিখাতে বিনিয়োগে তৈরি অবকাঠামো সুবিধা নিতে চান তারা এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। বর্তমানে স্যামসাংসহ কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে ।বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম কনজুমার মার্কেট, এখানে বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণি রয়েছে। এখানে স্টার্টআপদের জন্য বিশাল সুযোগ রয়েছে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে মেইড ইন চায়না বা ভিয়েতনামের মত বাংলাদেশের তৈরি মোবাইল হ্যান্ডসেট, হার্ডড্রাইভে ‘মেইন ইন বাংলাদেশ’ দেখা যাবে। ২০২৫ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার! আমার বিশ্বাস আইটি রপ্তানি এক সময় পোশাক খাতকে ছাড়িয়ে যাবে। মহামারীকালে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে মোবাইল ইন্টারনেট, ই কর্মার্স, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের প্রসার বেড়েছে মহামারীর এই সময়ে।

দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে প্রযুক্তির বিপ্লব মানেই এখনো ভালো নেটওয়ার্ক। কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের স্বপ্ন দেখালেই চলবে না, আরেকদলকেও নিদারুণ বাস্তব থেকে উদ্ধার করতে হবে। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে খুব কঠিন কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে এইটা সত্যি। তেমনি নতুন সুযোগ তৈরী হবে- এটা বিশ্বাস করবারও অনেক কারণ আছে। তবে কথা হচ্ছে সেই সুযোগগুলো গ্রহণ করতে দেশ ও ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা প্রস্তুত হচ্ছি কি না।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

মন্তব্য করুন


Link copied