নিউজ ডেস্ক: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ২২ মহাসড়কের ব্যাপক আধুনিকায়ন এবং উন্নতির পরেও দূরপাল্লার কোচসহ সব ধরনের যানের গতি কমে যাচ্ছে। এতে সড়কপথের যাত্রীদের যাতায়াতের সময় বেড়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মহাসড়কে স্বল্পগতির ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার মতো যানের দৌরাত্ম্য। উল্টো দিক থেকে আসা অল্পগতির এসব অবৈধ যানের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, লরি ও প্রাইভেটকারের অভিজ্ঞ চালকরা এখন অনেক বেশি শঙ্কিত থাকেন। কিছুক্ষণ পরপরই গতি ঘণ্টায় ৮০-৯০ কি.মি. থেকে কমিয়ে ২০-৩০ কি.মি. করতে হয়। এতে করে ফের কাঙ্ক্ষিত গতিতে উঠতে বড় যান/চালককে বেশ বেগ পেতে হয়। এসব কারণে মহাসড়ক উন্নত হওয়া সত্ত্বেও বাস-ট্রাকের চালক কাঙ্ক্ষিত গতিতে বেশিক্ষণ চালাতে পারছেন না।
দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বলে খ্যাত এই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে গত তিন দশকের বেশি সময় যাতায়াতকারী আশফাকুর রহমান জাবের চৌধুরী বলেন,‘ঢাকা-টু-ফেনী বা ফেনী-টু-ঢাকা এই দূরত্ব এক দশক আগেও পাড়ি দিতে এসব অত্যাধুনিক কোচের সময় লাগত দুই ঘণ্টা বা সোয়া দুই ঘণ্টা। কিন্তু এখন লাগছে কমপক্ষে ৪ ঘণ্টা বা এর বেশি সময়। যদিও ইতোমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এখন সময় লাগার কথা ছিল দুই ঘণ্টারও কম কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আসা তিন-চাকার অটোর জন্যে দ্রুতগতির বাস এদের কাঙ্ক্ষিত গতিতে (ঘণ্টায় ৮০-৯০ কি.মি.) টানা ২০-৩০ মিনিট ছুটে যেতে পারছে না। কিছুক্ষণ পরপরই চালককে ব্রেক কষতে হচ্ছে।’
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদে কর্মরত এই কর্মকর্তা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, দুই দশক আগেও গেট লক যাত্রীসেবা সুপার নামে একটি সিটিং সার্ভিস চালু ছিল ফেনী-ঢাকা-ফেনী রুটে। এরা বিভিন্ন স্থান থেকে থামিয়ে থামিয়ে যাত্রী তুললেও তিন ঘণ্টার মধ্যে অনায়সে ফেনীর মহিপাল থেকে রাজধানীর সায়েদাবাদে পৌঁছে যেতে পারতো। ৬/৭ বছর আগেও কাঁচপুর ব্রিজ মাত্র দুই লেনের সংকীর্ণ একটি সেতু ছিল। ২০১৮ সালে এটি ৪-লেনে উন্নীত হয়। ২০১৮ সালের জুলাইতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ২-লেন থেকে ৪-লেনে উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে গাড়ির মানও অনেক উন্নত হয়েছে। ভাড়া বেড়েছে ৬/৭ গুণ। এতো উন্নয়নের পরেও গত কয়েক বছর দেখা যাচ্ছে, গন্তব্য পৌঁছাতে আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি সময় লাগছে।’
অল্পগতির এসব অধিকাংশ অনিবন্ধিত এবং অবৈধ যানের কারণে ভারী এবং দূরপাল্লার যানবাহনগুলোর গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, যা যাত্রাপথের সাচ্ছন্দ্য এবং সময়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
পৃথিবীজুড়ে মহাসড়ক উন্নতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যাত্রাপথের সময় ও যাত্রীর স্বস্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উন্নতি সত্ত্বেও গন্তব্যে পৌঁছাতে যে সময় লাগত এক দশক আগে, এখন তা বেড়ে গেছে। গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় গাড়ির চালকরা যতটা খেয়াল রাখেন, তা যদি না হতো তবে দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও বেড়ে যেতো।
মহাসড়ক উন্নত হলেও যাতে গাড়ির গতি বাড়ানোর কোনো সুযোগ কমে যায় তবে উন্নতির প্রকৃত অর্থ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্দেশ্য মূলত জনগণের যাত্রাকে দ্রুততর এবং আরামদায়ক করা। কিন্তু সড়কের কিছু অংশে নতুন ব্যাটারিচালিত গাড়ির প্রবণতা এবং অল্পগতির যানবাহনের উপস্থিতি, বিভিন্ন বাস এবং কোচের গতিকে চরমভাবে ব্যাহত করছে।
এ প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী দ্রতগতি এবং স্বল্পগতির যানবাহন কখনই একই লেনে চলতে পারে। উল্টো দিক বা রং সাইট থেকে আসার কথাতো চিন্তাই করা যায় না। অনেক সময় দেখা যায়, দুর্ঘটনায় মূল হোতা (ইনস্টিগেটর) অনেক ক্ষেত্রে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, অটো, মোটরসাইকেল ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে। এসব চালকরা মোটেও প্রশিক্ষিত নন। এমন যান কোনভাবেই মহাসড়কবান্ধব নয়। ত্রি-হুইলার এবং মোটরসাইকেল মহাসড়কে পঙ্গপালের মতো ছুটে চলে। ভোটের রাজনীতি করে যারা ক্ষমতায় যায় তাদের পক্ষেও আর অবৈধ যান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেও এখন আর এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর নয়। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে গিয়ে এই সরকারকেও দুবার পিছুপা হতে হয়েছে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের এই অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক আরও বলেন,‘বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এখন বলছে এসব যান (ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার) এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তারা কেন এই ক্যানসার শুরুতে আচঁ করতে পারেনি। অবৈধ এসব যান এখন আমাদের গোটা দেশের পরিবহনখাতে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। শুরুতে যখন এদের সংখ্যা কয়েক'শ ছিল তখন কেন এসব নিয়ন্ত্রণ করা হলো না। বিআরটিসি কেন এটি বুঝতে পারেনি। এখন বলছে এটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’
অধ্যাপক শামসুল হক আরও বলেন, ‘এসব অবৈধ যান উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলেই একদল মানবতাবাদী মানুষ অটোচালক ও তাদের পরিবারের পক্ষ নেন। এই কয়েক হাজার লোকের সাময়িক জীবিকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ গোটা দেশের মানুষের যাতায়াতের সময়, নিরবচ্ছিন্ন আমদানি-রপ্তানি এবং দেশের অর্থনীতি। মহাসড়কের এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে বিদেশি ক্রেতারা (বায়ার) এদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আর যদি এসব অটোরিকশা তুলে দিয়ে কমপক্ষে মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায় তখন এই অটো চালকদের আরও ভালো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’