জান্নাতুন নাহার
রেললাইনপাড়—সময়ের সঙ্গী হয়ে এগিয়ে চলা ট্রেন যেমন ছুটে যায় গন্তব্যের দিকে, তেমনি এই রেলপথ ঘিরে গড়ে ওঠা মানুষের জীবনও প্রতিনিয়ত ছুটে চলে সংগ্রাম, আশা আর বাস্তবতার নানা বাঁকে। এখানে বসবাসকারী মানুষগুলো যেন অর্ধেক শহুরে, অর্ধেক ভ্রমণকারী; স্থায়ী ঠিকানা নেই, তবু জীবন থেমে থাকে না। প্রতিদিন সূর্যের আলো ফোটার আগেই শুরু হয় তাদের জীবনযুন্ধ। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতায় কাটে।
রেললাইনপাড়ের মানুষের স্বাস্থ্য মানে হলো প্রতিনিয়ত ধুলো, শব্দ, দূষণ আর অনিশ্চয়তার সঙ্গে যুদ্ধ। সারাদিনের খাটুনি—রিকশা চালানো, দিনমজুরির কাজ, ফুটপাথের দোকান সামলানো—সবকিছুর মাঝেই শরীরকে চালিয়ে যেতে হয়।
পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব, মানসিক চাপ, নিরাপদ পানির সংকট তাদের সুস্থতার সবচেয়ে বড় বাধা। তবে তবুও তারা নিজেদের মতো করে সুস্থ থাকতে চেষ্টা করেন—দ্রুত হাঁটা, হালকা ব্যায়াম, আর এক মুঠো বিশ্রামই তাদের শক্তি পুনরুদ্ধারের উপায়।
এলাকার বাজারগুলোতে সস্তায় পাওয়া সবজি, ভাত-ডাল, ডিমই তাদের প্রধান খাবার। অনেক পরিবার দিনশেষে অবশিষ্ট খাদ্যের ওপরও ভরসা করে।
তবু খাদ্য নিয়মিত না হলেও চেষ্টা থাকে পুষ্টি পাওয়ার। মায়েরা বাজার থেকে টাটকা শাকপাতা বা ঋতুভেদে ফল কিনে সন্তানদের পাতে দেওয়ার চেষ্টা করে। সামান্য সামর্থ্যের মধ্যেও কীভাবে পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখা যায়—রেললাইনপাড় যেন তার বাস্তব উদাহরণ।
রেলপথের পাশের মানুষদের কাছে ট্রেন শুধু যানবাহন নয়—হৈচৈ, শব্দ, আলো আর এক ধরনের সঙ্গ।
অনেকে ট্রেনে চড়ে বিভিন্ন শহরে যায় কাজের খোঁজে, আবার কেউ ট্রেনের কোলাহলকেই ভ্রমণের অনুভূতি মনে করে। রেলস্টেশনের চায়ের দোকান, গরম সমুচার গন্ধ—সবই তাদের ছোটখাটো আনন্দযাত্রা।
রেললাইনপাড়ের পরিবারগুলো একে অপরের ওপরই ভরসা করে। সংকটে প্রতিবেশীরা এসে দাঁড়ায়, অসুস্থ হলে খবর নেয়, প্রয়োজন হলে খাবার ভাগ করে খায়।
শিশুরা খেলাধুলা করে একসঙ্গে—টিনের বল, কাঠের গাড়ি, কিংবা কাগজের ঘুড়িতে তাদের পৃথিবী।এখানে শিশুদের নেই কোন ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা।
কিন্তু তবুও কোনো বাবা চায় তার সন্তান যেন স্কুলে যায়, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। অনেক নাম করে। কিন্তু আর্থিক অবস্থার কারণে শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। তারা সব সময় অবহেলিত, কোন সুযোগ-সুবিধা তারা পায় না। তারপরেও তাদের জীবন চলে নিয়তির নামে।সংগ্রাম যতই কঠিন হোক, তারা নিজেদের মতো করে উন্নতির চেষ্টা চালিয়ে যান।
রেললাইনপাড়ে বিনোদন মানে হলো সন্ধ্যায় রেডিওর গান, ঘরে বসে সিনেমা দেখা, ঈদের সকালে নতুন জামা পরে দৌড়ে বেড়ানো।
স্টেশনের পাশে গল্প জমানো, চায়ের কাপে আড্ডা—সব মিলিয়ে বিনোদন এখানে বিলাসিতা নয়, বরং মনকে ভালো রাখার একমাত্র জানালা।
রেললাইনপাড় শুধু এক টুকরো এলাকা নয়—এটি অগণিত মানুষের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, স্বপ্ন দেখার সাহস, আর প্রতিদিন টিকে থাকার গল্প।
তাদের জীবন সাদামাটা হলেও আছে অসীম শক্তি, আছে পারস্পরিক ভালোবাসা, আর আছে আশার আলো—ট্রেনের আলোয় ঝলমল করা কোনো সন্ধ্যার মতো।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।