আর্কাইভ  সোমবার ● ২৬ মে ২০২৫ ● ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ২৬ মে ২০২৫
আল-জাজিরার বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে ড. ইউনূস প্রশাসনের ভবিষ্যৎ কী?

সোমবার, ২৬ মে ২০২৫, রাত ০২:১১

Advertisement

নিউজ ডেস্ক:  বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ও এর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ঘিরে সম্প্রতি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চরমে পৌঁছে যায়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্ত:দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ এবং নির্বাচন নিয়ে মতানৈক্য সবমিলিয়ে এ সরকার এক গভীর সংকটে রয়েছে বলে এক বিশ্লেষণে তুলে ধরেছে আল-জাজিরা।

এতে বলা হয়েছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেস্টা ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের যে বৈঠক হয়, তা সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে একটি দরজার আড়ালে হওয়া বৈঠক।

সরকারে থাকা একাধিক সূত্র আল জাজিরাকে জানিয়েছে, গত ২০ মে’র ওই বৈঠকটি এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন ঢাকায় ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে যা ‘ঠাণ্ডা লড়াই’ হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে। সেই সামরিক-বেসামরিক টানাপোড়েন এখন ইউনূসের প্রশাসনের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে— ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দেওয়ার ৯ মাস পর।

২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তার ১৫ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষ ফুঁসে ওঠে ওই সময়, যাকে মূলত গুম-খুনের শাসন বলা হয়।

এদিকে ‍সম্প্রতি, ড. ইউনূস পদত্যাগ করছেন—এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে শনিবার (২৪ মে) এক মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদুদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা (ড. ইউনূস) আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন—তিনি পদত্যাগ করছেন না। অন্যরাও রয়েছেন। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব’।

সামরিক-বেসামরিক টানাপোড়েন কেন বাড়ছে?

২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণবিক্ষোভের মুখে পুলিশের কার্যক্রম ভেঙে পড়ার পর থেকেই মূলত সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছে। পুলিশ আগস্টে পুনরায় কাজ শুরু করলেও অস্থিরতার কারণে সেনা মোতায়েন অব্যাহত রাখা হয়েছে।

তবে গত ২১ মে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক বক্তৃতায় সরাসরি বলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। কারণ সেনাবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদি সিভিল দায়িত্ব জাতীয় প্রতিরক্ষা ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

ঢাকা সেনানিবাসে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। এটি নির্বাচিত সরকার দিয়েই সম্ভব, অর্পিত সিদ্ধান্তদাতা দিয়ে নয়’।

তার এই বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে দেশজুড়ে ও জাতিসংঘ মিশনে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইউনিফর্ম পরে যোগ দেন। এ সময় তার ওই বক্তব্য ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ বার্তা।

জেনারেল ওয়াকারের বক্তব্যের মূলপয়েন্টগুলো ছিলো-

• সেনাবাহিনী পুলিশ নয়—নির্বাচনের পর ব্যারাকে ফিরতে হবে;

• অস্থায়ী সরকার যেন দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত না নেয়;

• রোহিঙ্গা সংকটে রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর পরিকল্পনায় আপত্তি;

• চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বিদেশি হস্তক্ষেপ ও স্টারলিংক চালুর পরিকল্পনা নিয়ে নিরাপত্তা উদ্বেগ;

• সরকার সেনাপ্রধানকে সরাতে চেয়েছিল—এমন গুজব প্রচারিত হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে টানাপোড়েন

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকার ক্রমাগত রাজনৈতিক চাপে পড়ছে। কারণ, অন্যতম বড় দল বিএনপি চাচ্ছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরেই নির্বাচন। তবে আরেক বড় দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও নতুন দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টিসহ (এনসিপি) অন্যান্য দল বলছে, নির্বাচন নয়—আগে সংস্কার।

বিএনপি আরও দাবি করছে, ২০২০ সালের এক ‘জালিয়াতিপূর্ণ’ মেয়র নির্বাচন বাতিল করে তাদের প্রার্থীকে পুনর্বহাল করতে হবে। এছাড়াও বিএনপি চায় দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদত্যাগ করুক।

শনিবার (২৪ মে) প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক শেষে এসব দাবি জানায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। 

ইউনূস কি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন?

তবে তার আগে বৃহস্পতিবার (২২ মে) মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নাকি বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করছে না, আমি কার্যক্রম চালাতে পারছি না।

এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। যদি নির্বাচন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, আমি তার দায় নিতে পারব না’।

সেই রাতে এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম তাকে পদত্যাগ না করতে অনুরোধ করেন। এ সময় ড. ইউনূস তাকে বলেন, ‘আমি যেন জিম্মি হয়ে পড়েছি। সব রাজনৈতিক দল একমত না হলে আমি কাজ চালাতে পারব না’।

এদিকে দেশের মূল সংস্কারগুলোও ঝুলে আছে। যেমন-

• এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে;

• সিনিয়র কর্মকর্তারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন;

• সরকার প্রশাসনের বিভিন্ন অংশের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিএনপি কী চায়?

এ অবস্থায় বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা ড. ইউনূসের পদত্যাগ চাই না। আমরা চাই, তিনি নির্বাচন দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন’।

তার কথায়, ‘সংস্কার ও নির্বাচনের কাজ একসঙ্গে চলতে পারে। বর্তমানে পরিবেশ অনেক অনুকূল রয়েছে, শেখ হাসিনার আমলের মতো নয়। বিচারিক কার্যক্রম আলাদা পথে চলুক, তবে নির্বাচন কার্যক্রম থামবে না’।

অন্যান্য দলের মধ্যে এনসিপি অভিযোগ তুলে বলছে, বিএনপি পুরোনো ক্ষমতার রাজনীতি করছে।

অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (আইএবি) ও জামায়াতে ইসলামী একে ‘জাতীয় ঐক্য’ গঠনের সময় বলছে। 

জামায়াতে ইসলামী চাইছে- নির্বাচন আগে নয়, প্রতিরোধ আইন, প্রোপোরশনাল ভোটিং ও নতুন সংবিধানের রূপরেখা আগে তৈরি হোক।

সামনে কী হতে পারে?

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি বলেন, ‘ড. ইউনূসের পদত্যাগ আলোচনা একটি সতর্ক সংকেত হতে পারে। কেননা, এর অর্থ হলো-সংহতির অভাব এবং সরকারের ভেতরে মতবিরোধ বাড়ছে’।

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের আহ্বান দিলে সেটি বিএনপিপন্থি অবস্থান হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার জনগণের’।

এদিকে, এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম এক ফেসবুক পোস্টে সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, ‘আবার ১/১১-এর ষড়যন্ত্র চলছে’। 

তিনি ড. ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন-

• জুলাইয়ের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হোক;

• ডিসেম্বর-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন;

• জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার; ও

• সংবিধান সংস্কারের রূপরেখা ও গণপরিষদ নির্বাচন।

পরিশেষে বলা যায় যে, একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর অসন্তোষ—এই দুয়ের মাঝে পড়ে বাংলাদেশের জন্য যে গণতান্ত্রিক উত্তরণের স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল, তা এখন চরম অনিশ্চয়তার মুখে। প্রশ্ন হচ্ছে, ড. ইউনূস এই উত্তাল সময়ে কতটা দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারবেন?

অনুবাদ করেছেন: নাজমুস শাহাদাৎ

মন্তব্য করুন


Link copied