নিউজ ডেস্ক: কুষ্টিয়া পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে একটি বহুতল ভবনের পার্কিং জোনে ল্যান্ড ক্রজার প্রাডো ব্যান্ডের একটি বিলাসবহুল গাড়ির সন্ধান মিলেছে। গাড়িটি ভারতে খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারের। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আনার এমপির কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেন, ‘কুষ্টিয়াতে ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ব্র্যান্ডের যেই গাড়ির সন্ধান মিলেছে, সেই গাড়িটি আমার বাবার।
ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ব্র্যান্ডের গাড়িটির মালিক আমার বাবা আনোয়ারুল আজীম আনার। এই গাড়িতে করে আমি আর আমার বাবা চলাফেরা করেছি। আমাদের গাড়ি আমাদেরকে ফেরত দেওয়া হোক। বাবার গাড়ি আমরা ফেরত চাই।
ডরিন বলেন, ‘আমার বাবাকে হত্যার ঘটনা ঘটার পর থেকে আমাদের ওই গাড়িটির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা বিলাসবহুল গাড়িটি কারো কাছে বিক্রি করিনি। গাড়ি ফেরত পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চাই। আমরা আমাদের গাড়ি ফেরত পেতে চাই।
এর আগে ৯ জুন রাতে কুষ্টিয়া পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনের ৮ তলা বিশিষ্ট সাফিনা টাওয়ার নামে ভবনের গ্যারেজে ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ব্র্যান্ডের গাড়িটি পাওয়া যায়। গাড়ি থেকে গাড়ির কাগজপত্র, সংসদ সদস্য ও সিআইপি স্টিকার উদ্ধার করেছে পুলিশ। কালো কালারের গাড়িটির নম্বর ‘ঢাকা মেট্রো-ঘ ১২-৬০৬০’। কোটি টাকার গাড়িটি ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) নিহত আনোয়ারুল আজীম আনারের বলে ধারণা করছে পুলিশ ও স্থানীয়রা।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই স্বপন বলেন, ‘গাড়ির খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে আসি।
গাড়ি থেকে কাগজপত্র, সংসদ সদস্য ও সিআইপি স্টিকার উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, গাড়িটা ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের। বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ওই বাসার কেয়ারটেকার আলমগীর হোসেন বলেন, ‘জেনুইন লিফ কম্পানি নামে একটা সিগারেট কম্পানি ২য়, ৩য় ও ৪র্থ তলায় বাসা ভাড়া নিয়েছে। সেখানে ফরেনাররা আসেন, থাকেন এবং খাওয়া-দাওয়া করেন। তারাই গাড়িটা রাখার ব্যবস্থা করেছেন। জেনুইন লিফ কম্পানির বেলাল স্যার জিএম আর জাহিদ স্যার সিইও। প্রায় তিন মাস আগে গাড়িটি এখানে এনে রাখা হয়। জাহিদ ও বেলাল স্যারের হেফাজতে গাড়িটি ছিল। এই ভবনে মোট সাতটি ইউনিট ভাড়া নেন তারা৷ এছাড়াও পার্কিং ভাড়া নেন। গাড়িটা বাইরে বের করা হয় না। তবে মাঝেমধ্যে স্টার্ট দেওয়া হয়। চালক শান্ত গাড়িটা স্টার্ট দেন।’
গাড়িচালক শান্ত বলেন, ‘আজ থেকে ৫ বছর আগে আমি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগার আলীর গাড়ির ড্রাইভার ছিলাম। এখন আর নেই। আমি জেনুইন লিফ কম্পানির গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করি। জিএম স্যার বেলাল ও সিইও জাহিদ স্যারের গাড়ি চালাই। তারা দুজন আমাকে চাবি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলেন। জেনুইন লিফ টোব্যাকোর বেলাল ও জাহিদ স্যারের হুকুমে আমি স্টার্ট দিয়েছি। গাড়ির মালিক কে, তা আমি জানি না। বেলাল স্যার আর জাহিদ স্যার সব কিছু জানেন। তাদের হুকুমে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছি। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। গাড়ি থেকে পুলিশ কাগজপত্র, লাইসেন্স ও স্টিকার উদ্ধার করেছে। সেখানে গাড়ির মালিকের নাম লেখা আছে। এই গাড়িটি আমি কখনো চালাইনি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেনুইন লিফ কম্পানি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় নতুন প্রসেসিং কারখানা করছে। কম্পানিটির মালিক আব্দুস সবুর লিটন। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। নরসিংদী জেলায় ‘তারা ট্যোবাকো’ নামে ব্যবসা পরিচালনা করেন। এছাড়া সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল চৌধুরীর সঙ্গে ‘বিজয় ট্যোবাকো’ নাম দিয়ে একসঙ্গে ব্যবসা করতেন লিটন। ৫ আগস্টের আগে দৌলতপুর উপজেলায় তারা ও বিজয় টোব্যাকোর নামে তামাক ক্রয় করতেন লিটন। বিএনপির দুই নেতার ছত্রছায়ায় লিটন নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছেন ভেড়ামারায়।
নওফেলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক পার্টনার লিটন। গাড়িটি আওয়ামী লীগের কোনো নেতার মাধ্যমে লিটনের কম্পানির লোকজন এখানে নিয়ে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। লিটনের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন জাহিদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি। এছাড়া বেলাল হোসেন নামের এক জিএম আছে। তাদের হেফাজতে গাড়িটি ছিল বলে স্থানীয়রা ধারণা করছেন। আব্দুস সবুর লিটন ও নওফেলের নেতৃত্বে কুষ্টিয়ায় নকল গোল্ডলিফ ও বেনসন সিগারেট তৈরি করে এই চক্রটি। তারা দীর্ঘদিন ধরেই কুষ্টিয়া সদর, মিরপুর, দৌলতপুর ও ভেড়ামারায় গোপন কারখানায় নকল সিগারেট তৈরি করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আমরা প্রথমে শুনতে পাই যে, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের গাড়ি রাখা আছে সাফিনা টাওয়ারের গ্যারেজে। পরে পুলিশে খবর দেন স্থানীয়রা। পুলিশ গাড়ি থেকে গাড়ির কাগজপত্র উদ্ধার করেছে। সংসদ সদস্যের স্টিকার উদ্ধার করেছে। এই গাড়ির চালক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগার আলী ছিলেন এক সময়। তিনিই গাড়ি থেকে কাগজপত্র ও স্টিকার দেন পুলিশকে। গাড়ির কাগজপত্র দেখে বোঝা যায় যে গাড়ির মালিক ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানাচ্ছি। এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন ও মালিকানা পত্রে আনোয়ারুল আজীম আনারের নাম উল্লেখ রয়েছে। সাফিনা টাওয়ারের ফ্ল্যাট মালিক ও ভাড়াটিয়ার চুক্তিপত্র অনুযায়ী মেহেরপুর জেলার গাংনী পৌরসভার বাঁশবাড়িয়া দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা মো. মুস্তাফিজুর রহমান ভবনের তিনটি ইউনিট ও তিনটি গাড়ির পার্কিং স্পেস ভাড়া নেন। গাড়িটি বর্তমানে মুস্তাফিজুর রহমানের পার্কিং স্পেসে রয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ভাড়া নিয়েছেন তিনি। মুস্তাফিজুর রহমান কুষ্টিয়ার দশ মাইল এলাকায় অবস্থিত ‘তারা টোবাকো’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখন ছুটি চলছে। অফিস খুললে বিআরটিএ থেকে গাড়ির বিষয়ে তথ্য চাওয়া হবে। এরপরই নিশ্চিত হওয়া যাবে আসলে গাড়িটির মালিক আনার নাকি অন্য কেউ।’
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১২ মে দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান তৎকালীন এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। ১৬ মে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনি। ২২ মে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে খবর শোনা যায়। তবে এখন পর্যন্ত তার মরদেহ উদ্ধার করতে পারেনি ভারতীয় পুলিশ। পরে পুলিশ জানায়, এমপি আনারকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করা হয়। পরে সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেয় খুনিরা।