আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ১৯ জুন ২০২৫ ● ৫ আষাঢ় ১৪৩২
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ১৯ জুন ২০২৫
ইরান বলছে তারা হোয়াইট হাউজের ‘পা চাটবে না’

ইরান বলছে তারা হোয়াইট হাউজের ‘পা চাটবে না’

ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সদর দফতরে বিমান হামলার দাবি ইসরায়েলের

ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সদর দফতরে বিমান হামলার দাবি ইসরায়েলের

পরমাণু স্থাপনার কিছুই করতে পারেনি ইসরায়েল, দাবি ইরানের

পরমাণু স্থাপনার কিছুই করতে পারেনি ইসরায়েল, দাবি ইরানের

ইরানি হামলায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ইসরায়েলিরা

‘বেরোতে ভয় পাচ্ছি’
ইরানি হামলায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ইসরায়েলিরা

স্থাপত্যশিল্প ও পৌরাণিক ঐতিহ্যের অপূর্ব সমন্বয়ে গড়া কান্তজিউ মন্দির

বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫, রাত ০১:০২

Advertisement

দিনাজপুর প্রতিনিধি :   প্রকৃতির মায়াময় লীলাভূমি এই বাংলাদেশ। এই দেশে রয়েছে অগণিত ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর মধ্যে কান্তজিউ বা কান্তনাগর মন্দির একটি অনন্য রত্ন। অষ্টাদশ শতাব্দীর এই ইটের মন্দিরটি ইন্দো-পারস্য ভাস্করশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। ইট, বালু, টেরাকোটা ও কঠিন পাথরের সংমিশ্রণে তৈরি মন্দিরটি দেশের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর মন্দির হিসেবে বিবেচিত।

উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম জেলা দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের কান্তনগর গ্রামে অবস্থিত এই মনোমুগ্ধকর কান্তজিউ মন্দির। জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে, দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিম পাশে ঢেঁপা নদীর তীরে শ্যামগড় এলাকায় এই গ্রামটি অবস্থিত। প্রাচীন কান্তজিউ মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক মহিমার কারণে এই গ্রামটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।

জনশ্রুতি রয়েছে, মন্দিরের নির্মাণ সামগ্রী সুদূর আসামের পর্বত ও হিমালয় থেকে আনা হয়েছিলো। এর নির্মাণকাজের জন্য বেশিরভাগ কর্মী পারস্য থেকে এসেছিলেন।

মন্দিরের দেয়ালে পোড়ামাটির অলঙ্করণে নানা পৌরাণিক কাহিনি অপূর্বভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মহারাজা প্রাণনাথ রায় ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী রুক্মিণীকে উৎসর্গ করে এই মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তার পালকপুত্র রাজা রামনাথ রায়ের শাসনকালে ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ শেষ হয়।

শ্রীকৃষ্ণের ১০৮টি নামের মধ্যে ‘শ্রীকান্ত’ একটি। মহারাজা প্রাণনাথ এই নাম অনুসারে মন্দিরটির নাম রাখেন কান্তজিউ মন্দির। এখানে ‘কান্ত’ শ্রীকৃষ্ণের নাম বোঝায় এবং ‘জিউ’ শব্দটি সম্মান প্রকাশ করে। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর এর নামেই গ্রামটির নামকরণ হয় কান্তনগর। মন্দিরটিতে ছিলো নবরত্ন বা ‘নয় শিখর’ শৈলীর স্থাপত্য।

১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে এই শিখরগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৬০ সালে তৎকালীন সরকার কান্তনগর মন্দিরকে সংরক্ষিত প্রাচীন কীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে মন্দিরটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

কান্তজিউ মন্দির নির্মাণে প্রধানত তিনটি পৌরাণিক কাহিনিকে কেন্দ্র করে অলঙ্করণ করা হয়েছে। মানুষের মূর্তি ও প্রাকৃতিক দৃশ্য বিভিন্নভাবে মন্দিরের দেয়ালে শিল্পায়িত হয়েছে। মহাভারত ও রামায়ণের কাহিনীর পাশাপাশি শ্রীকৃষ্ণের বিবিধ লীলা, সমকালীন সমাজজীবনের দৃশ্য এবং জমিদার অভিজাতদের বিনোদনের চিত্র অত্যন্ত কারুকার্যময়ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

পোড়ামাটির এই শিল্পকর্মগুলোর বিস্ময়কর প্রাচুর্য, মূর্তির কোমল ভঙ্গিমা এবং সৌন্দর্য এতটাই যত্নসহকারে রচিত যে, বাংলার অন্য যেকোনো ম্যুরাল শিল্পের তুলনায় কান্তজিউ মন্দিরের অলঙ্করণ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। দেয়ালের এই শিল্পকর্ম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বিস্ময় জাগে। দর্শনার্থীরা এর অপূর্ব শৈল্পিক নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান।

মন্দিরের বাইরের দেয়ালের উত্তরদিকে অবস্থিত প্রতিমূর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কৃষ্ণ ও বলরামের মূর্তি। এখানে কৃষ্ণের বিবাহের বিভিন্ন দৃশ্য, গোপিনীদের দণ্ডের দুই প্রান্তে শিকায় ঝোলানো দুধ ও দইয়ের ভাড় বহনের চিত্র সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিভিন্ন যুদ্ধের দৃশ্যও অত্যন্ত নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কংসের দানবীয় হাতি কুবলয়াপীড়ের ধ্বংসের দৃশ্য। মথুরায় কংসের সঙ্গে যুদ্ধে কৃষ্ণের অংশগ্রহণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে রাধার মূর্ছা যাওয়ার মর্মস্পর্শী দৃশ্যও এখানে উপস্থাপিত হয়েছে।

এছাড়া, একটি বৃত্তের মধ্যে নৃত্যরত রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি, রসমণ্ডল এবং সহায়ক অন্য মূর্তিগুলো অপূর্ব শৈল্পিকতায় শোভা পাচ্ছে।

কান্তজিউ মন্দিরের নির্মাণশিল্পীরা ছিলেন অসাধারণ দক্ষতাসম্পন্ন। তারা তাদের মেধা ও মননের সমন্বয়ে এই অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন। পরিশীলিত ও পরিণত শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে তারা একটি সুসংহত ধারায় অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে মন্দিরের অলঙ্করণ করেছেন।

মন্দির সূত্রে জানা যায়, কান্তজিউ মন্দিরে সমস্ত ধর্মীয় উৎসব মর্যাদা ও ভক্তিভরে উদযাপিত হয়। এর মধ্যে রাসমেলা একটি বিশেষ উৎসব। বাংলা কার্তিক মাসজুড়ে এই মন্দিরে রাসমেলার আয়োজন চলে। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাসলীলার উপলক্ষে এই উৎসব শুরু হয়। দেশ-বিদেশ থেকে আগত হাজারো তীর্থযাত্রীর পদচারণায় মন্দির প্রাঙ্গণ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। উৎসবের সময় ঢোল, কাঁসরের সুরধ্বনি এবং নারীদের উলুধ্বনিতে রাসমেলা এক উৎসবমুখর পরিবেশে জমে ওঠে।

ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে কান্তজিউ মন্দিরে দোলপূর্ণিমা উৎসব ভক্তিভরে উদযাপিত হয়। পুণ্যার্থীরা এই দিনে ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং রঙ ছিটিয়ে উৎসবটি পালন করেন। এই উৎসবে অসংখ্য দর্শনার্থীর সমাগমে মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়। এছাড়া, তারকব্রহ্ম নামযজ্ঞ, শিবরাত্রি ব্রত এবং স্নানযাত্রা উৎসবও কান্তজিউ মন্দিরে মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়।

উৎসবের সময় ভারত, নেপাল, ভূটানসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা কান্তজিউ মন্দির দর্শনে আসেন। এছাড়াও বছরের প্রায় সব সময় কমবেশি দেশীয় পর্যটকদের পদচারণা থাকে।

কান্তজিউ মন্দিরে আসা পর্যটকদের জন্য সরকারিভাবে একটি সরকারি ডাকবাংলো ও পর্যটন মোটেল রয়েছে। এখানে থাকার পাশাপাশি খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে আবাসিক হোটেল।

 

কান্তজিউ মন্দিরকে সরকারিভাবে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে সরকার পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য সেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে মন্দিরের ভেতরে পুলিশের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপিত হয়। যেখানে পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকেন।

মন্তব্য করুন


Link copied