নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে যে বিপ্লব হয়েছে সেটি নানা কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণে এই বিপ্লব হয়েছে। যেটির নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ-যুবকরা। তারুণ্যের শক্তি যে রোখা যায় না, সেটি আবারও প্রমাণ হলো ঢাকায়। তরুণদের ডাকে শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে সব শ্রেণিপেশার মানুষ এতে যোগ দেয়। যেটি পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।দুই মাসব্যাপী রক্তাক্ত আন্দোলনের সফলতা ধরা দেয় ৫ আগস্ট, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পলায়নের মধ্য দিয়ে।
চব্বিশের আন্দোলনে একক কোনো নেতৃত্ব ছিল না। বিপ্লবের নাটাই ছিল না কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের হাতের মুঠোয়। তরুণ ছাত্র-শক্তি ছিল বিপ্লবের অগ্রভাগে। তৎকালীন অরাজনৈতিক সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই বিপ্লবের নিউক্লিয়াস। এই আন্দোলনের নেতারা ১৮ কোটি মানুষের ভবিষ্যত নির্মাণে জীবন ঝুঁকি নিয়েছেন।
পৃথিবীর যেখানেই বিপ্লব হয়েছে সেখানেই কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিংবা সংগঠন অথবা ক্যারিশম্যাটিক লিডার সামনে ছিলেন। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবে নেপোলিয়ন বেনাপোর্ট, ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবে ভ্লাদিমির ইলিয়চ লেনিন, ১৯৪৯ সালে চীনা বিপ্লবে মাও সে তুং, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি নেতৃত্ব দিয়ে চূড়ান্ত বিপ্লব বয়ে আনেন। বিপ্লব ছাড়াও বড় যেকোনো আন্দোলনের সফলতার জন্যও বড় কোনো নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়; বাংলাদেশে জুলাইর বিপ্লবের সেই অর্থে ছিল ব্যতিক্রম। চব্বিশের আন্দোলনে একক কোনো নেতৃত্ব ছিল না। বিপ্লবের নাটাই ছিল না কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের হাতের মুঠোয়। তরুণ ছাত্র-শক্তি ছিল বিপ্লবের অগ্রভাগে। তৎকালীন অরাজনৈতিক সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই বিপ্লবের নিউক্লিয়াস। এই আন্দোলনের নেতারা ১৮ কোটি মানুষের ভবিষ্যত নির্মাণে জীবন ঝুঁকি নিয়েছেন।পুলিশ-র্যাব মার দিয়েছে, ডিবি তুলে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্ভাব্য সব স্থানে তাদের খোঁজাখুঁজি করেছে, রাষ্ট্রের অন্যান্য বাহিনী নির্মূলের হুমকি দিয়েছে। এতোসব বাধা ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে গেছেন নাহিদ, হাসনাত, আসিফরা। টলে নি। তাদের দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৭ বছরের অন্ধকার ভেদ করে আলোর দেখা মিলেছে।
৫ আগস্ট এদেশে গণআকাঙক্ষার বিজয় হয়েছে। দর্প চূর্ণ হয়েছে ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার। যেটি ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত অনেকের কল্পনায়ও স্থান পায়নি। একনায়ক ও জবরদস্তিমূলত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। গুলি-গ্রেনেড-হামলা-মামলার মুখে বিরোধী দলের একের পর এক আন্দোলনের ব্যর্থতায় একটা সময় দেশের মানুষ মনে করতে শুরু করে যে এই জগদ্দল পাথরকে বাংলার জমিন থেকে সরানো যাবে না। আন্দোলন করে লাভ হবে না। সেই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছে তারুণ্য। রাজপথে তাদের দৃঢ়তা ফ্যাসিবাদী শক্তির মূল উৎপাটন করে দিয়েছে। যার ফলে মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে ১৮ কোটি মানুষ।
৫ আগস্ট এদেশে গণআকাঙক্ষার বিজয় হয়েছে। দর্প চূর্ণ হয়েছে ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার। যেটি ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত অনেকের কল্পনায়ও স্থান পায়নি। একনায়ক ও জবরদস্তিমূলত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। গুলি-গ্রেনেড-হামলা-মামলার মুখে বিরোধী দলের একের পর এক আন্দোলনের ব্যর্থতায় একটা সময় দেশের মানুষ মনে করতে শুরু করে যে এই জগদ্দল পাথরকে বাংলার জমিন থেকে সরানো যাবে না। আন্দোলন করে লাভ হবে না। সেই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছে তারুণ্য। রাজপথে তাদের দৃঢ়তা ফ্যাসিবাদী শক্তির মূল উৎপাটন করে দিয়েছে। যার ফলে মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে ১৮ কোটি মানুষ।
জুলাই বিপ্লবের বার্ষিকীতে আমাদের পিছু ফিরে তাকানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ৫ জুন সরকারি চাকুরির নিয়োগ ব্যবস্থায় কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভের মধ্যে ২০১৮ সালে সরকার কর্তৃক জারি করা সার্কুলারকে অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। ঘোষণার পরপরই, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে এবং বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের জন্য ৫৬% চাকরি সংরক্ষণ করার সুবিধা দেওয়ার কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
সরকার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেও শিক্ষার্থীরা ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে অস্বীকার করে এবং কোটা বাতিলের নতুন নির্বাহী আদেশের দাবি জানায়। মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিণতি পেয়েই জুলাই বিপ্লবে রূপ নেয়। যেই গণআন্দোলনে ১৫০০ তাজা জীবন ঝরে যায়। আমরা কী একবার ভেবে দেখেছি, যদি এই আন্দোলন ব্যর্থ হতো কী হতো নাহিদ-হাসনাতসহ লাখো তরুণদের?
জুলাই বিপ্লব আরও কিছু কারণে স্মরণকালের ইতিহাসে অনন্য। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। সাঈদ অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বুলেটের সামনে নিজের বুক যেভাবে বিছিয়ে দিয়েছেন এটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শুধু গল্পেই মানায়। সেদিন গুলি লাগার মুহূর্তে রাজপথে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের ছবি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে মানুষ শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন। এই আন্দোলনই রূপ নেয় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে।
আন্দোলনরত তরুণদের তৃষ্ণা নিবারণে মুগ্ধর ‘পানি লাগবে পানি’ এই ডাক এখনও কানে বাজে। আন্দোলনকারীদের তৃষ্ণা নিবারণ করায় হাসিনার পেটুয়া বাহিনী সড়কের ফেলে মুগ্ধকে যেভাবে খুন করল তাকে কি বুঝতে অসুবিধা হয় যে, তাদের রক্তের নেশা পেয়ে বসেছিল। সাঈদ-মুগ্ধর মতো দেড় হাজার তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে হাসিনার পোষা লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী।
জোহরের নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার সময় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার সাইন্স বিষয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী শাইখ আস-হা-বুল ইয়ামিন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন দমনে সাভারের ব্যাংক টাউন এলাকায় ১৭ জুলাই নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল পুলিশ। জোহরের নামাজ পড়ে বের হয়ে বাসায় ফিরছিলেন ইয়ামিন। ঠিক তখনই গুলিবিদ্ধ হন ইয়ামিন। তাকে পুলিশ তাদের সাঁজোয়া যান এপিসিতে উঠায়। একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ ইয়ামিনের নিথর দেহ পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়। আর এ দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এই বর্বরোচিত ঘটনা দেখে দেশের মানুষ বিস্মিত ও হতবাক হয়ে যায়। আন্দোলন আরও গতি পায়।
যাত্রবাড়ি অনেকটা লেলিনগ্রাদের মতো রূপ নেয়। সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা পুলিশের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তা দেখলে গা শিউরে উঠে।
চব্বিশের বিপ্লবে বাবা-মা তাদের সন্তানদের ঘরে বেধে রাখতে পারেননি। তারা ছুটে এসেছেন রাজপথে। সন্তানদের পথ ধরে বাবা-মাও এসেছেন রাজপথে। ঢাকার সড়কে এক বাবা তো ঘুরে ঘুরে বলেই বেড়াচ্ছিলেন যে-আমার সন্তান এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে; আপনার সন্তানদেরকেও পাঠান। তুমুল আন্দোলনের মুখে এক সন্তানকে হাতকড়া বেঁধে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল আইনশৃংখলা বাহিনী; তখন মা সন্তানকে সাহস দিয়ে বলছিলেন-যাও ভয় পেও না।
চব্বিশের আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসের রাজপথে থেকে শিক্ষার্থীদের প্রেরণা যোগানো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম রাব্বানীর নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি করে সাহস যোগানো, ড. সলিমুল্লাহ খানের ঘোষণা-অপরাধীর কাছে বিচার চেয়ে লাভ নেই, সরকারের পতন ঘটাতে হবে—এই স্মৃতিগুলো এখনও হৃদয়ে নাড়া দেয়।
চব্বিশের আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসের রাজপথে থেকে শিক্ষার্থীদের প্রেরণা যোগানো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম রাব্বানীর নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি করে সাহস যোগানো, ড. সলিমুল্লাহ খানের ঘোষণা-অপরাধীর কাছে বিচার চেয়ে লাভ নেই, সরকারের পতন ঘটাতে হবে—এই স্মৃতিগুলো এখনও হৃদয়ে নাড়া দেয়।
জুলাই বিপ্লবের নেপথ্যে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের অবদানও কি জাতি ভুলতে পারবে? বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী, কওমী আলেমদের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, আন্দালিব রহমান পার্থের বিজেপি নেপথ্যে থেকে জোরালো ভূমিকা রাখে। এই দলগুলোর বহু নেতাকর্মী রাজপথে থেকে আন্দোলনকে পরিণতি এনে দেয়।লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার দলের নেতাকর্মীদের ছাত্রদের পাশে থাকার নির্দেশ দেন। বিএনপি-ছাত্রদলের কয়েকশ নেতাকর্মী এই গণআন্দোলনে নিহত হয়।
এই বিপ্লবে রাজনীতির রঙ না লাগানোর আরও একটা কারণ ছিল। যদি এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সামনে আসতেন তাহলে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে পারত। তৎকালীন সরকার বিশ্ববাসীকে বোঝাতে সক্ষম হতো যে, এটি নিছক ছাত্রদের আন্দোলন নয়। রাজনৈতিক আন্দোলন। সেই অছিলায় সেভাবেই ক্র্যাকডাউন চালানো হতো।