আর্কাইভ  রবিবার ● ৬ জুলাই ২০২৫ ● ২২ আষাঢ় ১৪৩২
আর্কাইভ   রবিবার ● ৬ জুলাই ২০২৫
এখনও শহীদ মীর মুগ্ধকে অজান্তে খুঁজে ফেরে তার পরিবার

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
এখনও শহীদ মীর মুগ্ধকে অজান্তে খুঁজে ফেরে তার পরিবার

রংপুরের  প্রিয় সহ জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
রংপুরের প্রিয় সহ জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার

রংপুরে তিনজন সহ গেজেটে নাম নেই ২৩ জুলাই শহীদের, অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায় পরিবার

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
রংপুরে তিনজন সহ গেজেটে নাম নেই ২৩ জুলাই শহীদের, অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায় পরিবার

মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ দিবস পালনের আহ্বান

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ দিবস পালনের আহ্বান

জুলাই বিপ্লব-২০২৪

আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গর্বিত নিহা

রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫, দুপুর ০২:৩৫

নিউজ ডেস্ক: ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান নিহার। ইচ্ছা ছিল ভালো একটি সিজিপিএ নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে সোজা বিদেশে পাড়ি জমানোর। সরকারি চাকরি বা দেশে থাকার তেমন কোনো পরিকল্পনাও ছিল না নিহার।

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। পড়াশোনা আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে যখন নিহা বিভোর, তখনই এক মর্মান্তিক খবর তার হৃদয় স্পর্শ করে, আলোড়িত করে। ১৪ জুলাই, ২০২৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় নির্মম হামলা। এ ঘটনা নাড়িয়ে দেয় নিহার ভেতরের সুপ্ত প্রতিবাদী সত্তাকে। ‘সরকার এবার বেশি করছে... এত বছর সাধারণ জনগণের ওপর অত্যাচার করত, এখন শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম হামলা শুরু করল, যারা আমাদের ভাই-বোনের মতো’Ñফেসবুকে পোস্ট করেন তিনি। এরপর ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রদের আহ্বানে ১৬ জুলাই আইইউবিএটি’র সামনে থেকে একটি ছোট মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি উত্তরা খালপাড় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তারা সেখানে বিকাল পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। শুধু আইইউবিএটি নয়, উত্তরা এলাকার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন। নিহার জন্য এটি ছিল জুলাই বিপ্লবে প্রথম পদক্ষেপ।

১৭ জুলাই, ঢাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যখন ছাত্রলীগ ও পুলিশ তাদের নারকীয় হামলা শুরু করেছিল, তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ঢাকার অনেক জায়গায় তখন তাণ্ডব চলছিল আর এর প্রতিবাদে নিহা ও তার সহপাঠীরা আইইউবিএটির সামনে এক মশাল মিছিলের আয়োজন করেন। ওই মশাল মিছিলটি দ্রুতই সারা দেশে ভাইরাল হয়ে যায়। ছাত্রলীগ কর্মীরা এটিকে ‘শিবিরের মিছিল’ বলে অপপ্রচার চালান।

নিহার ভাষ্যমতে, ১৮ জুলাই এক বিভীষিকাময় দিন, যা কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভুলতে পারবেন না। আজও এসব দিনের কথা মনে পড়লে অনর্গল চোখের পানি ঝরে, থামতে চায় না। সেদিন সকালে আইইউবিএটির সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করেন এবং সকাল ১০টার দিকে মিছিল বিএনএস সেন্টারের দিকে রওনা হয়। মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরাসহ আরো অনেকে এই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। বিএনএস সেন্টারে পৌঁছানোর পর পুলিশ লাগাতার টিয়ার গ্যাস আর ওপেন শুট শুরু করলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। আমি কয়েকজন সহপাঠীসহ বিএনএস ফুটওভার ব্রিজের নিচে মূল সড়কে বসে পড়ি। টিয়ার গ্যাস থেকে বাঁচতে অনেকেই তাদের মাস্ক, পেস্ট, পানি দিতে শুরু করেন, যা দিয়ে তারা পুরো শরীর ঢেকে দেন। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, পায়ে ব্যথা ছিল। মাঝে কয়েকজন এসে জানান, আইইউবিএটির কয়েকজনের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। এমন খবর শুনে আমি ও আমার সঙ্গীরা ঘাবড়ে যাই। পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছিল, সবাই এদিক-সেদিক দৌড়াচ্ছিল। আমি ও আমার এক সহপাঠী একটি মার্কেটের নিচে লুকাই, যেখানে আমরা আরো কয়েকজন আহত মানুষকে দেখতে পাই। দোকানগুলো বন্ধ থাকলেও ভেতর থেকে মানুষ তাদের সাহায্য করছিল।

আমি তাদের থেকে পানি নিয়ে আহত ভাইদের দিই। একজন আহত ভাই তার মাথায় হাত দিয়ে বলেন, ‘আপনাদের মতো বোনরা পাশে আছে বলে আমরা এ লড়াই করার সাহস পাচ্ছি।’ এ কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ আবার গুলি চালানো শুরু করে। আমরা তখন সেখান থেকে পালিয়ে একটি ছেলেদের হোস্টেলে আশ্রয় নিই। সেখানে আগেই কয়েকজন আহত শিক্ষার্থী আশ্রয় নিয়েছিলেন।

বিকালে তাদের হোস্টেল ছেড়ে দিতে বলা হয়, কারণ পুলিশ ও ছাত্রলীগ ততক্ষণে বিএনএস সেন্টারের পুরো এলাকার অলিগলিতে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা শুরু করেছিল। হোস্টেলের সামনে পুলিশ চলে আসার খবর পেয়ে তারা সেখান থেকে পালিয়ে উত্তরা মেডিকেল হাসপাতালে যান, যেখানে হাজার হাজার আহত শিক্ষার্থী ছিলেন। নিহাকেও সেখানে নিয়ে সেলাই দিয়ে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে বসিয়ে রাখা হয়। একের পর এক রক্তাক্ত শরীর নিয়ে মানুষ আসতে দেখে অনেকে সেন্সলেস হয়ে যান। পরে তাদের ফ্যাকাল্টিরা এসে নিরাপদে উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে নিয়ে আসেন। সেদিন রাতে নিহা তার বাসায় থাকা নিরাপদ মনে করেননি, তাই কয়েকজন মিলে এক আপুর বাসায় আশ্রয় নেন। ১৮ জুলাই রাতে খবর আসে, ১০ নম্বর সেক্টরে পুলিশ যেসব বাসায় শিক্ষার্থীরা আছেন, সেখানে রেইড দিচ্ছে। ভয়ে তারা পুরো বাসার লাইট অফ করে রাখেন । কী করবে বুঝতে পারছিলেন না কেউ। তারা যে বাসায় ছিলেন, তার বাড়িওয়ালা জানিয়েছিলেন, কাউকে ভেতরে আসতে দেবেন না। পুলিশ এসে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলে দারোয়ান বলেন, ‘কোনো ছাত্রছাত্রী নেই এ বাসায়, চলে গেছে।’

এদিকে ভয়ে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। সবাই চিন্তা করছিলেন হয়তো আজই তাদের মেরে ফেলবে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তারা দেখতে পান শটগান হাতে নিয়ে পুলিশ বাসার পাশে লিঙ্ক রোডের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে তারা ভেতরে চলে যান। পুরো রাত ভয়ে নির্ঘুম পার হয়। সকালে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নিজেদের বাবা-মায়ের কাছে চলে যান। নিহার পরিবার থেকেও তাকে বাসায় চলে যাওয়ার জন্য জোর করা হয়। তখন তিনি তার পরিবারের কাছে ফিরে যান।

আতঙ্ক নিয়ে একের পর এক রাত কাটতে থাকে নিহার। প্রতি রাতে দেখেন দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর করা হামলা আর তাদের লাশ। প্রতিটি রাত-দিন এভাবে আতঙ্কে পার করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারো কোনো খবর পাচ্ছিলেন না দেখে মোবাইলে একে অন্যকে মেসেজ দেওয়া শুরু করেন। সারা বাংলাদেশে হাসিনার নারকীয় হামলা চলছিল। তখন নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেননি বাসায়। পরিবারকে বললে তারা বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। কোনো উপায় না পেয়ে বাসাতেই থাকেন।

১ আগস্ট কোনোমতে পরিবারকে রাজি করিয়ে নিহা আবার ১০ নম্বর সেক্টরে এক আপুর বাসায় যান। আপু বলেন, ‘আর বসে থাকা যাবে না, আমাদের যারা ঢাকায় আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আন্দোলনে যোগ দেব আবার।’ সেদিন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার পর নিহা আবার যান আন্দোলনে। বিএনএস সেন্টার পর্যন্ত পুলিশ তাদের যেতে দেয় না। তখন ১১ নম্বর সেক্টরের এক গলিতে তারা লুকান। সেখানে তাদের ওপর ছাত্রলীগ পিস্তল আর লাঠি নিয়ে হামলা করলে তারা সবাই আলাদা হয়ে যায়। তারা যে কজন মেয়ে ছিল, তাদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করে। যখন তারা বের হতে থাকে, ছাত্রলীগ তাদের মাথায় পিস্তল ধরে রাখে এবং প্রতিটি মেয়েকে মারতে থাকে। মার খেয়ে তারা দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

এরপর ৩ আগস্ট যখন জানতে পারেন শহীদ মিনারে এক দফার ঘোষণা দেওয়া হবে, তিনি আবার নিজেকে প্রস্তুত করেন। আগের দিন ছাত্রলীগের লাঠির আঘাতে শরীরে অনেক জখম হওয়ায় প্রচুর জ্বর ছিল। কোনোমতে ওষুধ খেয়ে এবার একাই বের হয়ে যান শহীদ মিনারের উদ্দেশে। ঢাকার রাস্তায় তখন তেমন কোনো গাড়ি ছিল না, চারদিকে কারফিউ দেওয়া ছিল। আর স্পটগুলোতে পুলিশ দাঁড়ানো ছিল। গাড়ি না পেয়ে অনেক রাস্তা হেঁটে, আবার মাঝে রিকশা নিয়ে অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে শহীদ মিনারে পৌঁছে যান। সেদিন নিজেকে এক দফার সাক্ষী রাখতে পেরে গর্ববোধ হয় তার। সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বাজে, কারণ রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল।

অবশেষে আসে সেই বহুল প্রতীক্ষিত ৫ আগস্ট। তাদের মুক্তির দিন, জুলাই বিপ্লবের বিজয়ের দিন। ৪ আগস্ট রাতে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা হয় এবং জানানো হয় সেটি ৫ আগস্ট হবে। তখন আইইউবিএটি’র বিভিন্ন গ্রুপে বলা হয়, তাদের ইউনিভার্সিটির সামনে থেকে একদম ভোরে রওনা দেবে। ৫ আগস্ট সর্বপ্রথম উত্তরা থেকে লংমার্চ টু ঢাকা মিছিল বের হয়। নিহাসহ অনেকে আইইউবিএটির সামনে থেকে মিছিলে যোগ দেন। তারা বিএনএস সেন্টারে যাওয়ার পর সেনাবাহিনী প্রথমে তাদের যেতে দেয় না, যার কারণে তারা রাস্তায় বসে পড়েন। অনেকক্ষণ পর যখন মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন সেনাবাহিনী তাদের যেতে দেয়। এতে সবাই খুশি হয়ে দৌড়াতে শুরু করেন। মিছিল নিয়ে তারা যখন তেজগাঁও এলাকায় যান, তখন খবর পান খুনি হাসিনা পালিয়ে গেছেন। এরপর গণভবন, সংসদ ভবন—সবখানে গিয়ে তারা দেখেন লাখ লাখ মানুষের উল্লসিত সমাগম। চারদিকে মানুষের মনে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস! মুক্তির আনন্দ সবার চোখে-মুখে।

মন্তব্য করুন


Link copied