নিউজ ডেস্ক: টেলিযোগাযোগ সেবার অপব্যবহার রোধে আড়িপাতা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করাসহ বকেয়া আদায়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার ক্ষমতা সন্নিবেশিত করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এ খসড়া অধ্যাদেশ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন, ২০১০ বাতিল করে এ অধ্যাদেশ জারি হলে বিটিআরসি স্বাধীন সত্ত্বায় ফিরবে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগের শরণাপন্ন হতে হবে না।
খসড়া অধ্যাদেশ নিয়ে বিটিআরসি থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ই-গভর্ন্যান্স এবং ডিজিটাল সেবার পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে টেলিযোগাযোগ শিল্প একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিত্য-পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সংশ্লেষে আধুনিক, দক্ষ, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান নিশ্চিত করা বিটিআরসির অন্যতম দায়িত্ব। বৈষম্যহীনভাবে সরকারি-বেসরকারি সব অংশীজনের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন ও সুস্থ প্রতিযোগিতা লালনের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ খাতের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিটিআরসির স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতার ভারসাম্য স্থাপনের গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন, ২০১০ এর মাধ্যমে একদিকে যেমন নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা গুরুতরভাবে খর্ব হয়েছে, অপরদিকে তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিত দাপ্তরিক জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা এবং পক্ষপাতিত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যা সুস্থ প্রতিযোগিতার ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির পথে অন্তরায়। উপরন্তু মন্ত্রণালয়ের অধীন ছয়টি টেলিযোগাযোগ কোম্পানির জন্য ভিন্নতর নিয়ন্ত্রণ নীতি নির্ধারণ করা হলে তা নতুন করে বৈষম্যহীন বাজার-ব্যবস্থার পরিপন্থি হবে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন, ২০১০ অবিলম্বে বাতিল করে স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী আইনি কাঠামোর প্রবর্তন অপরিহার্য। টেলিযোগাযোগ বিভাগের চিঠির আলোকে বিটিআরসি অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। খসড়াটি প্রণয়নে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন, সাইবার সুরক্ষা আইন, ডেটা গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইন্টার-অপারেবিলিটি আইন, ন্যাশনাল এআই পলিসি, টেলিযোগাযোগ লাইসেন্স, মেইলিং ইকমার্স এবং কুরিয়ার সার্ভিস পলিসি ইত্যাদি বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
আড়িপাতা নিয়ে বিটিআরসির চিঠিতে বলা হয়, যেহেতু ইন্টারনেটসহ সামগ্রিক টেলিযোগাযোগ সেবা বর্তমান বিশ্বে মৌলিক মানবাধিকার স্বীকৃত, উক্ত অধিকার যেন অযৌক্তিক বা অযাচিতভাবে খর্ব না হয় সেজন্য মূল আইনের ধারা ৯৭ এর স্থলে নতুন ধারা ৯৭ প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ সেবার অপব্যবহার রোধে ‘আড়িপাতা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড প্রবর্তন, এনটিএমসি প্রশ্নে বৈধতার প্রশ্ন তৈরি করা, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মতে শুধু একটি এজেন্সিকে গেইটওয়ে করে বাকি এলআই এজেন্সিদের আড়িপাতায় কোয়াসি বা প্যাসিভ জুডিসিয়াল এনগেজমেন্ট’ ইত্যাদিসহ সার্বিকভাবে Lawful Interception বিষয়টি নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সংশ্লিষ্ট হওয়ায় ধারা ৯৭ক অংশটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরামর্শ অনুযায়ী পুনর্গঠন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এ সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষ, নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে Lawful Interception-এর পরিপূর্ণ আঙ্গিক এবং এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর দায়িত্ব, ক্ষমতা, এবং কর্মপদ্ধতির সুস্পষ্ট বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করতে পারেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিটিআরসির স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় নানাবিধ সমন্বিত ব্যবস্থা প্রয়োজন। প্রণীত আইন এবং সরকারের নীতিমালার অনুসরণে টেলিযোগাযোগ খাতকে ফলপ্রসূ ও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানের জন্য লাইসেন্স ইস্যুকরণ, নবায়ন, হস্তান্তর নিয়ন্ত্রণ, স্থগিতকরণ, বাতিলকরণ ইত্যাদি কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিটিআরসির থাকা আবশ্যক যার বিধান মূল আইন (বিটিআরএ ২০০১)-এ রয়েছে; এসব ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণের বিধান সংযোজন করা স্ববিরোধী।
অপরদিকে জবাবদিহিতার কাঠামোর প্রয়োজনে বিটিআরসির সব কমিশনারদের নিয়োগ ও নিয়োগের শর্ত নির্ধারণ আইনের ধারা ৯ মোতাবেক সরকার কর্তৃক সম্পন্ন হয়ে থাকে; অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগও সরকার কর্তৃক অনুমোদিত প্রবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এছাড়াও ধারা ২৭-২৮ অনুসারে বিটিআরসির বার্ষিক হিসাব-বিবরণী এবং আর্থিক-বিবরণী বাংলাদেশ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অর্ডার, ১৯৭৩-এর অধীনে নিবন্ধিত চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট ফার্মের মাধ্যমে নিরীক্ষা করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংসদে পেশ করার বিধান রয়েছে। উপরন্তু, কমিশন কম্পোট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (অ্যাডিশনাল ফাংশন) অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর আওতাধীন একটি সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের এখতিয়ারভুক্ত। অধিকতর প্রয়োজনে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বা অনুরূপ বিশেষজ্ঞ পর্ষদ কর্তৃক কমিশনের কার্যক্রম নিয়মিতভাবে যাচাইয়ের বিধানও সংযোজন করা যেতে পারে।
প্রযুক্তিক উৎকর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সুবিধার্থে বর্তমান খসড়াটির ধারা ৩০-এ নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন, ব্যবহার, গবেষণা, পরীক্ষামূলক চালুকরণ, বিধি-বিধান প্রণয়ন ইত্যাদি করার দায়িত্ব প্রদানের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। টেলিযোগাযোগ পরিকাঠামোর নিরাপত্তা বিধানের প্রস্তাবসহ সরকারের সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে তরঙ্গ-কে শেয়ারিং, ট্রেডিং, লিজিং, রি-ফার্ম করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়াও বর্তমান ডিজিটাল যুগে ওটিটি, কনটেন্ট সেবা এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের যোগাযোগ, বিনোদন, ব্যবসা এবং তথ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক সেবা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ওটিটি, কনটেন্ট, ডিজিটাল সেবা ইত্যাদির সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্তিসহ এ সংক্রান্ত বিষয়াবলির জন্য বিধিনিয়ম প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে আইপিডি ফোর থেকে আইপিডি সিক্স-এ মাইগ্রেশন, কোয়ালিটি অব সার্ভিস নিশ্চিতকরণ ও লাইসেন্স ইত্যাদি সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল বিধায় তা প্রবিধান, গাইডলাইন, আদেশ ও নির্দেশনার মাধ্যমেই ব্যবস্থাপনা করা সমীচীন বলে প্রতীয়মান হয়।
টেলিযোগাযোগ লাইসেন্স এবং সেবা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জরিমানা আরোপ, দেওয়ানী বিষয়াদির ক্ষেত্রে পিডিআর মামলা দায়েরসহ অপারেটর কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় যথাযথ প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রয়োজন সাপেক্ষে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়ে থাকে যা আইনে যথাযথভাবে বিভিন্ন ধারায় বিধৃত রয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, সরকারের রাজস্ব আদায় ও রাজস্ব লিকেজ রোধকল্পে ধারা ২৬(৩) নামে একটি নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে বিটিআরসি পাওনা বকেয়া আদায়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।