নিউজ ডেস্ক: গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই জাতীয় পার্টি (জাপা) নিষিদ্ধ করার দাবি উঠতে শুরু করে। সম্প্রতি জাপা ও গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় সেই দাবি আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে এখন রাজনৈতিক মহলে নতুন প্রশ্ন উঠেছে, যদি সত্যিই জাপা নিষিদ্ধ হয়, তবে দলটির সমর্থন ও ভোট কোন দলের পক্ষে যাবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে তাদের ভোট আসলে কোনো দলের ব্যাংকেই যাবে না। কারণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে পরপর তিনটি নির্বাচন হয়েছে। ওই নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মী ও সমর্থকরা কি ভোট দিতে গেছেন? যাননি। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। ফলে জাতীয় পার্টিও নিষিদ্ধ হলে তাদের ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন না। আর জাতীয় পার্টির মূল ভোট তো একটি অঞ্চলভিত্তিক। সঙ্গত কারণে, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হলেও তাদের ভোট অন্য কোনো দলের ব্যাংকে যাবে না।
তারা বলেন, একটি রাজনৈতিক দল ছোট হোক বা বড় তার কিছু ভোটব্যাংক থাকে। তার নির্দিষ্ট মতাদর্শের লোক থাকে। জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে জামায়াত, এনসিপির মতো দলগুলো লাভবান হবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে তাদের নিষিদ্ধ সঠিক প্রক্রিয়া নয়। যারা দোষী তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা যেতে পারে। তা না হলে আগামীতে কোনো দল নির্বাচিত হলেও তারা স্বস্তিতে থাকতে পারবে না।
পতিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করে ২০০৯ সালের ক্ষমতার স্বাদ নিতে শুরু করে জাতীয় পার্টি। পরে ২০১৪ সালে বিএনপিকে বাইরে রেখে আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচনে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে জাপা। এরপর ২০১৮-২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন ও সরকারের সঙ্গে থেকে গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। ফলে পতিত আওয়ামী লীগকে সবসময় জাতীয় পার্টি বিতর্কিত নির্বাচনে সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ করে আসছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই জাপা নিষেদ্ধের দাবি ওঠে রাজনৈতিক মহল থেকে। সম্প্রতি জাপা নিষিদ্ধের দাবি তোলে গণঅধিকার পরিষদ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জাপা ও গণঅধিকার পরিষদ নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ওইদিন রাতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর হামলার শিকার হলে জাপা নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হয়।
গত শনিবার ঝিনাইদহে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয় উদ্বোধন শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে তা যাচাই-বাছাই করে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নুরের ওপর হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক মন্তব্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, জাতীয় পার্টি ১৯৮২ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে। তারা জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে। তাদের পুরোনো ইতিহাস উন্মোচন করেছে। তাই নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, তা আইনগত দিক যাচাই-বাছাই করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নুরের ওপর হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, এটি সুগভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের একটি অংশ।
এদিকে রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে যমুনায় বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জাতীয় পার্টির ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে বলেছি, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের কার্যক্রম যেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম (রফিক শাহরিয়ার) বলেন, জাতীয় পার্টির ভোট অন্য কোথাও যাবে না। আওয়ামী লীগ যখন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি দলগুলোকে বাইরে রেখে নির্বাচন করেছে, তখন কিন্তু এ দলগুলোর নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ভোট দিতে যায়নি। ফলে জাপাকে নিষিদ্ধ করা হলেও তাদের ভোট অন্য কোনো দলের ব্যাংকে যাবে না। তারা ভোটকেন্দ্রে যাবে না। তবে ভোটকেন্দ্রে না গেলেও সহিংসতা ও সংঘাত বাড়তে পারে। এটি সরকার কীভাবে কন্ট্রোল করবে সেটি হচ্ছে বিষয়। তারা যদি কন্ট্রোল করতে না পারে তাহলে সংঘাত অনিবার্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী বলেন, একটা রাজনৈতিক দলের নেতা অপকর্ম করলে তাকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু দলের ওপর এর দায় চাপানো যায় না। রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়া নয়। এ দলকে নিষিদ্ধ করলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে। ফলে ভবিষ্যতে কোনো দল নির্বাচিত হলেও তাদের সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে দেবে না। কারণ তারা গত ১৬ বছরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচন সুষ্ঠু করার সম্ভাবনা কম। এতে সহিংসতা ও সংঘাত হবে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে। তারা গত ১৬ বছরে যেসব অপকর্ম করেছে, সেটি যদি জনগণ মনে রাখে এমনিতেই তাদের ভোট দেবে না। আর নিষিদ্ধ করলেও এ ভোট অন্য দল পাবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, নুরের ওপর হামলার পর জাতীয় পার্টি আরও বড় ধরনের চাপে পড়েছে। দলটি নিষিদ্ধের দাবি আরও জেরদার হয়েছে। বিএনপি প্রকাশ্যে নিষিদ্ধের দাবি করেনি। কিন্তু জামায়াত দাবি জানিয়েছে। জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে জামায়াত, এনসিপির মতো দল লাভবান হবে। কারণ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম তো নিষিদ্ধ। এখন যদি জাতীয় পার্টিকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তাদের সামনে বিএনপি ছাড়া আর কেনো বড় দল থাকবে না। ফলে তারা এখন জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। আর এখন দেশের বিভিন্ন এলকায় জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা শুরু হয়েছে। তবে কোনো দল নিষিদ্ধ হওয়া খুব সুখকর নয়। জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলেও তাদের ভোট কিন্তু অন্যরা পাবে না। কারণ আওয়ামী লীগের ভোটাররাও ভোট দিতে আসবে না। জাতীয় পার্টিও বেলাও একই অবস্থা হবে। এতে দেশে সংঘাত বাড়বে ছাড়া কমবে না।