বিনোদন ডেস্ক: ‘চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর, হায়রে অনেক দিনের পর, এই দুনিয়া ছাড়তে হবে এসেছে খবর, হায়রে এসেছে খবর। কারও কাছে চিঠি আসে বাবা-মায়ের, কারও কাছে প্রেমিকার। আমার কাছে চিঠি এলো ওপারে যাবার, হায়রে ওপারে যাবার।’ ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবিতে সালমানের গাওয়া এ গানটি যে অল্প সময়ে সত্যি হয়ে যাবে তা কি কেউ ভুলেও কখনো কল্পনা করতে পেরেছিলেন। সালমান শাহকে বলা হতো ঢাকাই ছবির সাফল্যের বরপুত্র। তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক। ঢালিউডের আকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে এ ক্ষণজন্মা তারকার। প্রয়াণের আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন আন-প্যারালাল, চিরবিদায়ের পরও হয়ে আছেন প্রবল জনপ্রিয় একজন নায়ক। আজ তাঁর প্রস্থানের ২৯তম বার্ষিকী।
স্বল্প সময়ে বিশাল কর্মজীবন
১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় ‘কথার কথা’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ শিরোনামের একটি গানের মিউজিক ভিডিওতে হানিফ সংকেতের কণ্ঠে গাওয়া গানের প্রধান চরিত্র অপূর্বর ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমেই সালমান শাহ মিডিয়ায় প্রথম আলোচিত হন। তখন তিনি ইমন নামেই পরিচিত ছিলেন। এর কয়েক বছর পর আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘পাথর সময়’ নাটকে এবং কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছিলেন। মাত্র চার বছরের অভিনয়জীবনে ২৭টি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র, কিছু দর্শকপ্রিয় নাটক, টেলিফিল্ম এবং বিজ্ঞাপনে মানসম্মত কাজ করে গেছেন সাফল্যের এ বরপুত্র। দুটি চলচ্চিত্রে শ্রুতিমধুর গানও গেয়েছেন তিনি।
অপ্রতিদ্বন্দ্বী ফ্যাশন আইকন
মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে ২৭ সিনেমার নায়ক সালমান শাহ। আর এ ২৭ সিনেমায় সালমান শাহ ফ্যাশন নিয়ে যা করে গেছেন, দীর্ঘ ২৪ বছরে ঢাকাই সিনেমার আর কোনো নায়ক তা করতে পারেননি। সালমান শাহর মৃত্যুর পর সিনেমার আর কোনো তারকা এখনো ভক্তদের ‘ফ্যাশন আইকন’ হয়ে উঠতে পারেননি। ১৯৯৩ সালে প্রথম ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায়ই ফ্যাশনে ভিন্নতা দেখিয়েছিলেন সালমান। ওই সিনেমায় তিনি মাথায় ভিন্ন স্টাইলের ক্যাপ পরেছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সিনেমায় সালমানের ফ্যাশনের তালিকায় ছিল মাথায় রংবেরঙের টুপি, স্ট্রিচ জিন্স প্যান্টের হাঁটুতে রুমাল বাঁধা, ছোট চিপের ব্যাকব্রাশ করা চুলের ডিজাইন, চুল ঝুঁটি করা, কানে দুল, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, টি-শার্টের সামনের দিকে ইন করে পেছনের দিকে একটু খুলে রাখা, বড় বকলেসওয়ালা বেল্ট পরা, ডান হাতে ঘড়ি পরা, কপাল ঢেকে রাখা ব্যান্ডেনা, গলায় আরবীয় রুমাল প্যাঁচানো, পুলিশি পোশাক ও টুপিতে রোদচশমা আর গোঁফ, দাঁত দিয়ে নখ কাটা, বড় চুলে ঠোঁটের কোণে সিগারেট রাখাসহ এমন অসংখ্য নিজস্ব স্টাইল তৈরি করেছিলেন সালমান। চুলের স্টাইলেও এনেছিলেন পরিবর্তন। সে সময় নতুন সিনেমা মুক্তির সঙ্গে সালমানের নিত্যনতুন স্টাইল দেখে পাড়া-মহল্লায় ফলো করার হিড়িক লেগে যেত। সালমানের মতো স্টাইলে চুল রাখত তাঁর ভক্তরা, পরত গোল ফ্রেমের চশমা, বিভিন্ন রঙের টুপি। এ ছাড়া কপাল ঢেকে রাখা ব্যান্ডেনা ও স্ট্রিচ জিন্স প্যান্টের হাঁটুতে রুমাল বাঁধা নব্বই দশকে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সালমানের জন্যই।
হৃদয়বিদারক দৃশ্য
চলচ্চিত্রনির্মাতা সায়মন তারেক বলেন, ‘যখন আমরা ঢাকা থেকে লাশ নিয়ে সিলেটে রওনা দিই, তখন রাস্তার দুই পাশে সালমানভক্তদের চিৎকার, আহাজারি, কান্না দেখেছি। অনেক ভক্ত সেদিন গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েছিলেন, লাশ না দেখালে তারা রাস্তা থেকে উঠবেন না...
ভালোবাসার স্বাক্ষর
সালমানের ভক্তকুলের অভাব নেই। এখনো তাঁর অনেক ভক্ত তাঁকে ভালোবেসে অনেক কিছু তৈরিও করছেন। তাঁর নামে ধামরাইয়ের ফিল্ম ভ্যালিতে হয়েছে শুটিং ফ্লোর। গাজীপুর সিটিতে তাঁর নামে হয়েছে বাসস্ট্যান্ড; তৈরি করা হয়েছে ভাস্কর্য। সালমান শাহর সবচেয়ে সুপারহিট সিনেমা ‘স্বপ্নের ঠিকানা’। এ সিনেমাটির নামে তাঁর ভক্ত মো. রাশেদুল ইসলাম (রাশেদ খান) নির্মাণ করেছেন একটি রিসোর্ট। যেখানে তৈরি হয়েছে সালমানের একটি নান্দনিক ভাস্কর্য। গাজীপুরের উলুখোলায় বীরতুল উত্তরপাড়ায় সালমানের এ ভাস্কর্যটি স্থাপিত হয়।
২৩ তরুণীর আত্মহত্যা
ঢাকাই চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা হার্টথ্রব নায়ক সালমানের অকাল মৃত্যুর খবর কেউ-ই মেনে নিতে পারেনি। শোনা যায়, ২৩ জনের মতো তরুণী আত্মহত্যা করে তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে। নজরুল নামে তাঁর এক বন্ধু ছিল। সালমান মারা যাওয়ার পর সে শুধু পাগলের মতো এফডিসির সামনে ঘুরে বেড়াত। ফারুক নামে আরেকজন বন্ধু ছিল তাঁর। সে-ও কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
মজার ঘটনা
একবার একটি মেয়ে অনেক দূর থেকে কলেজ ফাঁকি দিয়ে এসেছে সালমান শাহর সঙ্গে দেখা করার জন্য। সে সালমানের ফ্ল্যাটের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সালমান এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন কেন কলেজ ফাঁকি দিয়ে এসেছে সে। তারপর মেয়েটিকে চলে যেতে বললেন। আর এতে রাগ হয়ে মেয়েটি তাঁর সামনেই ব্লেড দিয়ে তাঁর একটি হাত কেটে ফেলল। সালমান যতক্ষণ এফডিসিতে থাকতেন, গেটের বাইরে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় থাকত তাঁকে একবার দেখার জন্য।

ভক্তকে সালমানের চিঠি
বিনয়ী সালমান : অসম্ভব ভালোবাসতেন ভক্তদের
আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় নায়ক হওয়া সত্ত্বেও সাফল্যের বরপুত্র খ্যাত সালমান শাহ ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও কোমল হৃদয়ের একজন মানুষ। চলচ্চিত্রকারদের মতে নায়করাজ রাজ্জাকের পরে সালমান শাহই ছিলেন একমাত্র নায়ক যাকে অহংকার কখনো ছুঁতে পারেনি। সেটে নির্মাতা শিল্পী কলাকুশলী এমনকি স্পট বয়দের সঙ্গেও খুব আন্তরিক ব্যবহার করতেন। কারও দুঃখ-কষ্ট দেখলে তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন। তাঁর ভক্তদের বেলায় তিনি এতটাই উদার ছিলেন যে, মহাব্যস্ত একজন নায়ক হওয়ার পরেও ভক্তদের সময় দিয়ে কথা বলতেন। কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না। এমনকি ভক্তের চিঠির জবাব দিতেও কখনো দ্বিধা করতেন না। বরং জবাব দিতে না পারলে তিনি অস্বস্তিতে ভুগতেন। চলচ্চিত্রের মানুষের কথায়- আমাদের চলচ্চিত্রের এমন এক সোনার ছেলেকে আমরা অকালে হারিয়েছি, এটি আমাদের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। সালমান শাহ আজীবন বেঁচে থাকবেন সবার হৃদয়ে।