আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ● ১০ আশ্বিন ১৪৩২
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
গাছ হারালে হারায় বিশ্বাস: মুন্ডাদের করম পূজা আজ স্মৃতির দ্বারপ্রান্তে

গাছ হারালে হারায় বিশ্বাস: মুন্ডাদের করম পূজা আজ স্মৃতির দ্বারপ্রান্তে

‘নভেম্বর থেকে চার মাসের জন্য খুলবে সেন্টমার্টিন’

‘নভেম্বর থেকে চার মাসের জন্য খুলবে সেন্টমার্টিন’

বাংলাদেশ-কসোভো সম্পর্ক জোরদারের আহ্বান

বাংলাদেশ-কসোভো সম্পর্ক জোরদারের আহ্বান

রংপুরে সেই বাগছাস নেতার পদ স্থগিত

শ্রেণিকক্ষে ঢুকে শিক্ষার্থী পেটানো
রংপুরে সেই বাগছাস নেতার পদ স্থগিত

গাছ হারালে হারায় বিশ্বাস: মুন্ডাদের করম পূজা আজ স্মৃতির দ্বারপ্রান্তে

বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রাত ০৯:৪৭

Advertisement

নিউজ ডেস্ক: ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা পূর্ণিমা মুন্ডা তপ্ত দুপুরে অন্যদের সঙ্গে এসেছেন করম গাছকে স্মরণ করে পূজা করতে। তবে মনে প্রশ্ন, পূজা কি আদৌ সফল হবে? কারণ করম গাছের পরিবর্তে তিনি পূজা করছেন পিপুল গাছকে, যা দেখতে করম গাছের মতোই।

ছোখ ভরা সংশয় আর হতাশা নিয়ে পূর্ণিমা মুন্ডা বলেন, “আমরা পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শিখেছি বিপদ-আপদে, সন্তান-সন্ততির জন্য এই গাছকে পূজা করতে হয়। তাই আমিও আমার অনাগত সন্তানের জন্য করম দেবতাকে পূজা করছি। কিন্তু আমাদের এখানে করম গাছ নেই, পূজা তো করতেই হবে তাই এই গাছই ভরসা। ”

সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর ও আশপাশের এলাকায় বর্তমানে মুন্ডা জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার  মানুষের বাস। তবে তারা এখানকার আদি অধিবাসী নয়। ইতিহাস বলছে, প্রায় একশ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে ভারত থেকে তাদের আনা হয়েছিল শ্রমিক হিসেবে।

তখন সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অংশ ছিল গভীর জঙ্গল। জমি চাষযোগ্য করতে এবং কাঠ সংগ্রহ করতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। এ সময় ব্রিটিশরা ভারতের ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে মুন্ডাদের আনে। তাদের মূল দায়িত্ব ছিল জঙ্গল কেটে জমি তৈরি করা এবং বনাঞ্চল পরিষ্কার রাখা।

ব্রিটিশদের নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে মুন্ডারা ধীরে ধীরে সুন্দরবনের ভেতরে ছোট ছোট বসতি গড়ে তোলে। জঙ্গল কেটে তারা চাষের জমি তৈরি করে এবং স্থানীয় কৃষিকাজে নতুন ধারা আনে। ধীরে ধীরে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালিগঞ্জসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে তাদের স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠে।

মুন্ডারা মূলত ‘সরনা’ ধর্ম পালন করে, যার মূল কেন্দ্রবিন্দু ‘করম পূজা’। প্রকৃতি আর পূর্বপুরুষকেই তারা পূজা করে থাকে। তবে সময়ের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আজ হুমকির মুখে।

বর্তমানে এই গোষ্ঠী তাদের শত বছরের পুরোনো ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রাখার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

করম গাছকে তারা সমৃদ্ধি, শান্তি ও সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে। বিশেষ করে নারীরা সন্তান লাভ, পরিবারে সুখ-শান্তি ও সৌভাগ্যের জন্য এই পূজা করে থাকেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত চাপের কারণে উপকূলে করম গাছ বিরল হয়ে পড়েছে। ফলে করম পূজা সীমিত হয়ে আসছে, যা মুন্ডাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে সংকট তৈরি করছে।

গীতা মুন্ডা, পূর্ণিমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, সম্প্রতি জরায়ু অপসারণ করেছেন। পূর্ণিমা শঙ্কিত তার পূজায় দেবতা সন্তুষ্ট হবেন কি না, অন্যদিকে গীতা বিশ্বাস করেন, সঠিকভাবে পূজা করতে না পারার কারণেই তিনি দেবতার অসন্তুষ্টির শিকার হয়েছেন।

গীতা মুন্ডা বলেন, “করম গাছ নেই, সঠিকভাবে পূজা-অর্চনা করতে পারছি না। তাই রোগ-বালাই, বালা-মুসিবত আমাদের পিছু ছাড়ছে না। আমি নিজের জরায়ু হারিয়েছি। অথচ যখন পূজা করতে পেরেছিলাম, তখন সুখ-শান্তিতে, সমৃদ্ধিতে ছিলাম। ”

২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকেই উপকূলে করম গাছ আর জন্মাচ্ছে না বলে জানান মুন্ডারা। ফলে অনেক বছর তারা করম পূজা করতে পারেননি। পরে কিছু পরিবার বিকল্প হিসেবে করম গাছের মতো দেখতে ‘পিপুল গাছকে’ পূজা শুরু করে। তবে এ নিয়ে গোষ্ঠীর মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে।

করম পূজা পরিচালনা করেন পণ্ডিত নীলকান্ত মুন্ডা। তিনি বলেন, “আমাদের সরনা ধর্মে পিপুল গাছকে পূজা করার কোনো রীতি নেই। তাই করম গাছের পরিবর্তে পিপুল গাছ পূজা মানা হবে না। ” 

তিনি জানান, এই পূজা ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীতে শুরু হয়, উৎসব চলে তিন দিনব্যাপী। পূজার মূল প্রতীক করম গাছের ডাল বা শাখা, যা সমৃদ্ধি, শান্তি ও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে পূজার আসনে স্থাপন করা হয়।

পূজার আগের দিন কিশোরী ও তরুণীরা নাচ-গান করতে করতে করম গাছের ডাল সংগ্রহ করে আনে। ঢোল, বাঁশি, ঝুমুর নাচ আর লোকগানের মধ্য দিয়ে ডাল গ্রামের মাঝে স্থাপন করা হয়। ডালের চারপাশ সাজানো হয় ধান, চাল, ফুল, দুধ ও দই দিয়ে।

মূল পূজার দিন ভোর থেকে নারী, পুরুষ ও তরুণীরা উপবাস করে। তারা প্রার্থনা করে পরিবারের শান্তি, ভাইয়ের মঙ্গল, কৃষিতে সমৃদ্ধি ও সন্তানলাভের জন্য। পুরোহিত মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে করম দেবতাকে আহ্বান করেন। এসময় করম দেবতার কাহিনী শোনানো হয়, যা ভাইবোনের সম্পর্ক, কৃষি এবং সুখ-সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে গাওয়া হয়।

দিনভর চলে নাচগান ও পূজা-আর্চনা। রাতে আবার ঢোল-মাদল বাজিয়ে যুবক-যুবতীরা করম দেবতার প্রশংসায় নৃত্য পরিবেশন করে। উৎসবের সমাপ্তি ঘটে করম গাছের ডাল বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। ডালকে নদী, পুকুর বা মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। বিসর্জনের সময়ও চলে নাচগান, শেষে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।

মুন্ডা জনগোষ্ঠীর কাছে করম পূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয়, বরং পরিবার ও সামাজিক সংহতির প্রতীক। তাদের বিশ্বাস, করম দেবতার আশীর্বাদেই নারীরা বাচ্চা ধারণ করতে সক্ষম হয়, রোগবালাই দূরে থাকে এবং পরিবারে শান্তি বজায় থাকে।

কেন আইলার পর উপকূলে আর দেখা যাচ্ছে না এই গাছ, সে বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিহির লাল শাহার সঙ্গে। তিনি জানান, করম গাছ শাখা বা বীজের মাধ্যমে জন্মায়। বীজ থেকে চারা করা কঠিন, কারণ বীজ ছোট এবং বাতাস বা পানিতে ধুয়ে যেতে পারে। চারা গজানোর জন্য যথাযথ পানি, আলো, তাপমাত্রা এবং অক্সিজেন প্রয়োজন। বিশেষ করে লবণাক্ত মাটিতে বীজ সহজে অঙ্কুরিত হয় না, কারণ লবণ বীজের পানি শোষণ ও বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।

আইলার পর উপকূল অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে, যার কারণে এই গাছ এখন ওই এলাকায় বিপন্ন। কীভাবে উপকূলে এই গাছ রোপন করে টিকিয়ে রাখা যায় সে বিষয়ে গবেষণার করার ওপর জোর দেন তিনি। এই গাছ শুধু একটি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় সংস্কৃতির পরিচয়ই বহন করে না বরং পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্যও প্রয়োজনীয়। এই গাছের ফুল পরাগায়নে ভূমিকা রাখে যা কৃষিতে সমৃদ্ধি বয়ে আনে, যুক্ত করেন মিহির লাল।

ধর্মীয় সংকটে নারীদের মধ্য বাড়ছে সামাজিক হাতাশা
করম গাছ হারিয়ে যাওয়া শুধু ধর্মীয় সংকট নয়, নারীদের মধ্যে হতাশাও বাড়িয়েছে। ২০২৪ সালে পিএলওএস গ্লোবাল পাবলিক হেলথে (PLOS Global Public Health) প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকায় নারীদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উদ্বেগ, হতাশা ও মানসিক চাপ বেড়েছে। ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ নারী নিয়মিতভাবে উদ্বেগ, হতাশা এবং মানসিক চাপের শিকার।

২০২৫ সালে ফ্রন্টিয়ারস ইন পাবলিক হেলথে (Frontiers in Public Health) প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ১৪ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ওপর মানসিক ও শারীরিক প্রভাব পড়ছে। আর এর শিকার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ নারী, যারা নিয়মিতভাবে উদ্বেগ ও হতাশায় ভুগছেন।  

“আমরা কাজ করতে পারি না, কোনো কাজে সফলতা আসে না, যা ধরি তাই ব্যর্থ হয়। আমাদের মধ্যে নারীরা বেশিরভাগ মাসিক সমস্যায় ভোগেন। আমি নিজেও গোপানাঙ্গে চুলকানি, সাদা স্রাবসহ নানা স্ত্রীরোগে ভুগছি। আমাদের সহজে বাচ্চা হচ্ছে না, আর হলেও মারা যাচ্ছে। এসবই করম দেবতার অভিশাপ। আমরা যদি আমাদের পূর্ব পুরুষের পূজাটা করতে পারতাম, এত বিপত্তি থাকত না, কথাগুলো শঙ্কিত কণ্ঠে বলছিলেন ৩৫ বছর বয়সী আনন্দি মুন্ডা।

মুন্ডা নারীরা এখন সামাজিক জমায়েতে কম অংশ নিচ্ছেন, সম্প্রদায়ের বৈঠক বা অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকছেন। ফলে সামাজিক সংহতি দুর্বল হচ্ছে, পারিবারিক ও সম্প্রদায়ের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে।

এই জনগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করম পূজা ছাড়া নারীরা আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছেন, এতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও কমে যাচ্ছে। সমাজে অংশগ্রহণ কমার কারণে সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

‘আগে ছোটবেলায় করম পূজায় আমরা সবাই হাতে হাত রেখে পূজা করতাম হলুদ শাড়ি পড়ে, মা, ঠাকুমাকে দেখতাম করম দেবতার গীত গাইতে, পূজার আগে থেকেই পাড়ায় উৎসবমুখর পরিবেশ থাকত। এখন আর পূজাও হয় না সেভাবে, আমাদের একত্রিত উৎসবও পালন হয় না। পরিবারে বাবা, ভাইয়ের মঙ্গল চাইতাম আমরা কুমারীরা। এখন কার কাছে চাইব! আমাদের সম্প্রদায়ে আয়- উন্নতি, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নেই আগের মতো,” বলছিলেন ২১ বছর বয়সী দীপালি মুন্ডা।

“আমাদের জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি নেই। এ গাছের সঙ্গে মুন্ডাদের গান, পাঠ, পূজার ঐতিহ্যও জড়িয়ে ছিল, যা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেইসাথে আমাদের সংস্কৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে,” বলেন ভক্ত মুন্ডা।

জানা গেছে, ‘প্রেরণা’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা করম গাছ পুনরায় রোপণ ও করম পূজার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে কাজ করছে।

“কীভাবে এই গাছটি পুনরায় এই অঞ্চলে রোপন করা যায় সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি, একইসঙ্গে মুন্ডা সম্প্রদায়ের পূজার গান, গীতিকাব্য সংরক্ষণেও কাজ করে যাচ্ছি,” বলেন প্রেরণার হেড অব প্রোগ্রামার মো. তৌহিদুল ইসলাম।

তিনি জানান, সংস্কৃতি বিপর্যয়ের কারণে মুন্ডাদের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে। অনেক মুন্ডাই হিন্দু ও মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। সামাজিকভাবে হতাশার কারণে এই সম্প্রদায়ের নারীরা এখন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে কম। এসব সমস্যা দূর করতে মুন্ডাদের বিভিন্ন পূজা–পার্বন ও ঐতিহ্য পালনে অর্থনৈতিক সহযোগিতাও করছে বেসরকারি এই সংস্থা।

তবে আদিবাসিদের ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বলে আক্ষেপ করেন সুন্দরবন আদিবাসী মুন্ডা সংগঠনের সভাপতি পোপাল মুন্ডা।

“আজ আমাদের সম্প্রদায়ে এই করম পূজা নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। করম গাছ না পেয়ে অনেকেই পিপুল গাছের পূজার দিকে ঝুঁকছেন। তাহলে যখন পিপুল গাছও হারিয়ে যাবে তখন কোন গাছের পূজা করব! করম দেবতাকে আমাদের আদিপুরুষরা পূজা করতেন, এটা আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি। এটাতো এভাবে বিবর্তন হতে পারে না। অথচ আমাদের এই সংকট দূরীকরণে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই,” বলেন তিনি।

এ বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয় শ্যামনগর বনবিভাগে। তিনি জানান, করম গাছ বিলুপ্ত হওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই তাদের কাছে, এমনকি এই গাছ সম্পর্কে তারা অবগতও নন।

একইভাবে খুলনার ‘মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে’ যোগাযোগ করলে তারা জানান, এটা তাদের কাজ নয়। উপকূল অঞ্চলে মাটিতে লবণের মাত্রা এবং কতটুকু লোনা পরিবেশে এই গাছ টিকে থাকা সম্ভব, সে বিষয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেননি তারা।

কেন করম গাছ হারিয়ে গেল, সে বিষয়ে গবেষণা করছেন সাতক্ষীরার পিন্টু বাউলিয়া। তিনি বলেন, “আইলার পর এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের মাত্রা বেড়েছে, যা সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে লবণাক্ততা সহ্য করতে না পারা গাছ আর হচ্ছে না। যেমন- কুজ গাছ, করম গাছ।

“করম গাছ শুধু ধর্মীয় নয়, পরিবেশ ও কৃষির জন্যও জরুরি। এর ফুল মৌমাছি, প্রজাপতি, ভ্রমরসহ নানা পরাগবাহী পতঙ্গকে আকর্ষণ করে। এতে প্রাকৃতিক পরাগায়ন হয়, ধান-ডাল-সবজি-ফলের ফলন বাড়ে,” যুক্ত করেন তিনি।  

এই বিশেষজ্ঞের কথার প্রমাণ মেলে সিরাজগঞ্জের একটি ২০ বছরের করম গাছে। গাছের ডালে পাখির বাসা, গায়ে নানা পোকা, চারপাশে জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি।

অন্যদিকে সিরাজগঞ্জের মাহাতো আদিবাসীরাও এই গাছকে পূজা করে। প্রায় ১৫ হাজার মাহাতো গোষ্ঠী ৩৮টি গ্রামে বাস করে। কিন্তু সারা গ্রামে করম গাছ আছে মাত্র ১৫টি। উজ্জ্বল মাহাতো তাই নতুন করে করম গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে এই গাছের বীজ থেকে চারা রোপন করার প্রক্রিয়া অন্যান্য গাছের তুলনায় জটিল বলে জানান তিনি।

“গাছের বীজ থেকে চারা জন্মালে কৃষিতে সমৃদ্ধি আসে,” বলেন বিমলা মাহতো।

এছাড়া মাহাতো সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, করম গাছ শুধু ধর্মীয় নয়, চিকিৎসাতেও কাজে লাগে। গাছটির বাকল ও পাতা দিয়ে তারা নানা রোগের চিকিৎসা করে থাকেন।

“এই গাছের অংশ দিয়ে অনেক রোগের ওষুধ বানাই। আমরা কখনও ওষুধ কিনি নাই, ডায়রিয়া, অম্ল, চুলকানি, বসন্তসহ নানা রোগে আমরা এই গাছের ছাল-বাকল ও পাতার রস ব্যবহার করি এবং তা কাজে লাগে,” বলেন ৭৫ বছর বয়সী গৌরি মাহাতো।

আইইউসিএন করম গাছকে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রেখেছে। তবে ‘প্রাণ-প্রকৃতি পাঠশালা’র উদ্যোক্তা মাহবুবুল ইসলাম পলাশ এই গাছ বাঁচাতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গাছের গুরুত্ব শেখাতে তিনি নিজের সংগ্রহে করম গাছও রেখেছেন এবং রোপণেও কাজ করছেন।

জলবায়ুর অভিঘাতে আদিবাসীদের ধর্মীয় সংস্কৃতি
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে এমডিপিআই (MDPI) প্রকাশিত আন্তর্জাতিক রিলিজিওন অ্যান্ড ওয়ার্ল্ডভউ (Religion and Worldview) জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলো গভীর সংকটে। আদিবাসীরা শুধু জীবিকা নয়, হারাচ্ছেন তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতিও। গবেষণা অনুযায়ী, ঋতুচক্র অস্বাভাবিক হওয়া, বনজ সম্পদ হারানো ও জুম চাষ কমে যাওয়ায় উৎসব ও রীতি পালন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে আদিবাসীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ও সংকটে পড়ছে।  

ব্রাজিলের মাটো গ্রোসো (Mato Grosso) রাজ্যের আমাজন রেইনফরেস্টে পিরিপকুরা (Piripkura) সম্প্রদায় আজ পরিবেশ ও জলবায়ুজনিতে পরিবর্তনের কারণে গুরুতর ধর্মীয় সংকটে রয়েছে। মাত্র দুইজন সদস্য পাকি (Pakyî) ও তামানডুয়া (Tamandua) তাদের পবিত্র ভূমিতে বসবাস করছেন, যা তাদের আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু। বন উজাড় ও অবৈধ লগিং তাদের ধর্মীয় স্থানকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে।

 

একইভাবে পানামার গুনা ইয়ালা (Guna Yala) অঞ্চলের গুনা (Guna) আদিবাসী সম্প্রদায়ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে তাদের ঐতিহ্যবাহী দ্বীপবাস, যা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু, হুমকির মুখে পড়েছে। ২০২৪ সালে প্রায় ৩০০টি পরিবার তাদের মূল দ্বীপ গারদি সুগডুব (Gardi Sugdub) ছেড়ে নতুন বসতি ইসবার ইয়ালা (Isber Yala) তে স্থানান্তরিত হয়েছে।  রয়টার্সের সংবাদ

“যখন কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে আঘাত হানে তখন সেই সম্প্রদায়ের বিশ্বাসও মরে যায় আর এর সবচাইতে বেশি ভুক্তভোগী সম্প্রদায়ের নারীরা। কারণ নারীরাই ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানের সমস্ত ক্রিয়া পালন করে,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবায়দা নাসরিন।  

মুন্ডা গোষ্ঠীর করম পূজার বিষয়ে তিনি বলেন, “যখন গাছই বিপন্ন তখন কিভাবে করম দেবতার অস্তিত্ব স্মরণ করবে। তাই মুন্ডা গোষ্ঠী এখন নিজেদের অস্তিত্ব প্রশ্নেই বিপর্যস্ত ও বিষাদগ্রস্ত। আর এ সংকট অচিরে দূর না করতে পারলে এ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বির্বতন ঘটবে যা তাদের আত্মপরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। একইসঙ্গে এ সম্প্রদায়কে হুমকির মুখে ফেলবে।

[এই বিশেষ প্রতিবেদনটি আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (EJN)-এর ফেলোশিপের সহায়তায় তৈরি]

মন্তব্য করুন


Link copied