নিউজ ডেস্ক: বিশ্ব ইতিহাসে বিভিন্ন সময় আদালতের রায় বা বিপ্লবীদের হাতে বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, রাষ্ট্রদ্রোহ, সংবিধান লঙ্ঘন থেকে শুরু করে বিদেশি শক্তির সঙ্গে ষড়যন্ত্র—বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। ফায়ারিং স্কোয়াড, ফাঁসি, গিলোটিনের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল এসব নেতার।
ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সেই ঘটনাগুলোর সারসংক্ষেপ নিচে তুলে ধরা হলো-
ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস
১৬৪৯ সালের ৩০ জানুয়ারি, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসকে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং পার্লামেন্টের সঙ্গে বিরোধের জেরে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে তার এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাজা প্রথম চার্লসের মৃত্যুদণ্ড ইংরেজ গৃহযুদ্ধের পরিণতি এবং সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের জন্ম দেয়, যা আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে।
ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই
১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি, ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুইকে প্যারিসের রিভোল্যুশনারি ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের সময় রাজতান্ত্রিক শাসন এবং জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে গিলোটিনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই ঘটনা বিপ্লবীদের জয়ের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়, যা ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের পতনের সূচনা করে।
হাঙ্গেরির ইমরে ন্যাগি
১৯৫৮ সালের ১৬ জুন বুদাপেস্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় হাঙ্গেরির সমাজতান্ত্রিক নেতা ইমরে ন্যাগির। ১৯৫৬ সালের ব্যর্থ বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। তবে এটি একটি ‘শো ট্রায়াল’ হিসেবে পরিচিত, যা পরবর্তীকালে হাঙ্গেরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি নিজেরাই অবৈধ বলে স্বীকার করে।
পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো
১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল রাওয়ালপিন্ডি জেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর। ১৯৭৪ সালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নওয়াব মোহাম্মদ আহমদ খানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে লাহোর হাইকোর্ট তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। তবে পাকিস্তানে এই ঘটনা ‘জুডিশিয়াল মার্ডার’ হিসেবে বিবেচিত, যা পরবর্তীকালে দেশটির সুপ্রিম কোর্টও ‘বিচারিক ব্যর্থতা’ বলে ঘোষণা করে।
ইরানের আমির-আব্বাস হোবেইদা
১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আমির-আব্বাস হোবেইদাকে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং দুর্নীতির অভিযোগে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির অধীন হোবেইদার সরকারকে বিপ্লবীদের ‘দমনকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে তার বিচার ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। অনেকের মতে, এটি বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ডের খুব কাছাকাছি ছিল।
রোমানিয়ার নিকোলাই চাউশেস্কু
১৯৮৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চাউশেস্কু এবং তার স্ত্রী এলেনাকে একটি দ্রুত বিচারে গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই ঘটনা ইউরোপের কমিউনিস্ট শাসনের পতনের সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্ত হিসেবে পরিচিত।
ইরাকের সাদ্দাম হোসেন
২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ইরাকি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যা (১৯৮২ সালের দুজাইল গণহত্যা) এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দেশটিতে মার্কিন অভিযানের পর এই বিচার আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে, যদিও এর নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ইতিহাস পর্যবেক্ষকদের মতে, এই মৃত্যুদণ্ডগুলো শুধু আইনি সিদ্ধান্ত নয়, বরং রাজনৈতিক বাস্তবতার ফলাফল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতার পরিবর্তন, অভ্যুত্থান বা যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসব বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও রাষ্ট্রদ্রোহ—এই দুই অভিযোগেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড হয়েছে সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের।