আর্কাইভ  সোমবার ● ২০ অক্টোবর ২০২৫ ● ৫ কার্তিক ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ২০ অক্টোবর ২০২৫
লালমনিরহাটের নয়টি ইউনিয়নের ৫৬ ইউপি সদস্যের আ'লীগ-জাপা থেকে গণপদত্যাগ

লালমনিরহাটের নয়টি ইউনিয়নের ৫৬ ইউপি সদস্যের আ'লীগ-জাপা থেকে গণপদত্যাগ

রংপুরের পীরগঞ্জে টাকা না দেওয়ায় দাদিকে জবাই করে হত্যার ঘটনায় নাতি গ্রেফতার

রংপুরের পীরগঞ্জে টাকা না দেওয়ায় দাদিকে জবাই করে হত্যার ঘটনায় নাতি গ্রেফতার

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩টি ইউনিট বন্ধ ঘোষণা

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩টি ইউনিট বন্ধ ঘোষণা

রংপুরে টেকসই নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা  প্রণয়নে কর্মশালা অনুষ্ঠিত

রংপুরে টেকসই নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে কর্মশালা অনুষ্ঠিত

আমরা পড়াই, কিন্তু সন্তানকে খাওয়াতে পারি না: এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আর্তনাদ

সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, দুপুর ০৩:৪২

Advertisement

নিউজ ডেস্ক: সিলেটের এক মাদরাসায় ৩৪ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন মোহাম্মদ ইসহাক। অথচ তার মাসিক বেতন মাত্র ২৬ হাজার ৯৮০ টাকা। এই টাকায় সংসার চালানো তো দূরের কথা, তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচও জোগাতে পারেন না তিনি।

গত ১৭ অক্টোবর ইসহাক রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে অবস্থান নেন তিন দফা দাবিতে—এর মধ্যে অন্যতম দাবি বাড়িভাড়া ভাতা মূল বেতনের ২০ শতাংশে উন্নীত করা।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার যদি দাবি মেনেও নেয়, আমার বেতন বাড়বে মাত্র তিন হাজার টাকা। আমরা একটুখানি সম্মানজনক জীবনেরই তো দাবি করছি, কিন্তু আমাদের কথা সরকার শুনছে না।"

ইসহাকের কথায় ফুটে ওঠে হাজারো এমপিওভুক্ত শিক্ষকের ক্ষোভ ও হতাশা, যারা রাজধানীতে এসে বিক্ষোভ করছেন। তারা বলছেন, তাদের বেতন এত কম যে মৌলিক চাহিদাগুলোও তাতে পূরণ হয় না।

শিক্ষকদের অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় এবং উৎসব ভাতা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশে উন্নীত করা।

এমপিও হলো সরকারের একটি আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি। এর আওতায় সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের শতভাগ পরিশোধ করে। এর বাইরে শিক্ষকরা কিছু ভাতাও পান, তবে তা খুবই সামান্য।

প্রথমে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও তালিকাভুক্ত করা হয়। এরপর সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের নাম সরকারি বেতনভুক্ত তালিকায় (পেরোল) যুক্ত করা হয়।

শুরুতে কর্মস্থলে ঢোকার সময় এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক পান মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতন। এর সঙ্গে ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া ভাতা এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা।

গতকাল রবিবার সরকার এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা মূল বেতনের ৫ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছে, মাসিক ন্যূনতম ২ হাজার টাকা। কিন্তু শিক্ষকরা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

এর আগে সেপ্টেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাড়িভাড়া ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। সেটাকেও শিক্ষকরা "অপর্যাপ্ত" বলে নাকচ করেন।

বর্তমানে সারা দেশে ২৬ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষক এবং ১ লাখ ৭০ হাজার কর্মচারী কর্মরত।

শিক্ষকদের সংগঠন এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব দেলোয়ার হোসেন আজিজীর মতে, বাড়িভাড়া ভাতা ২০ শতাংশে উন্নীত হলে প্রত্যেক শিক্ষক মাসে অতিরিক্ত ১ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত পাবেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ভাতার দাবি মেনে নিলেও সরকারের বছরে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ব্যয় হবে, যেখানে এখন ব্যয় হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

আন্দোলনরত শিক্ষকরা বলছেন, জীবনযাত্রার ব্যয় যত দ্রুত বাড়ছে, সেই অনুপাতে তাদের আয় বাড়েনি। চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার টিকিয়ে রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই বাধ্য হয়েই তারা রাজপথে নেমেছেন।

চাঁদপুর থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে আসা একটি স্কুলের শিক্ষিকা সানোয়ারা বেগম বলেন, 'আমরা তিনবেলা ঠিকমতো খেতেও পারি না। আমার তিন বছরের মেয়েকে পুষ্টিকর খাবার দিতে পারি না।'

সুনামগঞ্জের শিক্ষক আবদুল আহমদ বলেন, 'আমাদের অনেকেই দিনমজুরের চেয়েও খারাপ অবস্থায় থাকি। দিনমজুররা বেশি পরিশ্রম করে বেশি আয় করতে পারে। কিন্তু আমরা যত ক্লাসই নিই, যত নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াই না কেন, আমাদের বেতন বাড়ে না।'

নারায়ণগঞ্জের আরেক শিক্ষক বলেন, 'আমাদের সন্তানরা বড় হয় এই ধারণা নিয়ে যে শিক্ষক মানেই সারাজীবনের কষ্ট।'

এই প্রতিবেদক গত ১৭ অক্টোবর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্দোলনে অংশ নেওয়া অন্তত ২৫ জন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। এর মধ্যে অন্তত ৯ জন তাদের কর্মস্থল তাদের নিজ জেলা থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে থাকেন। তাদেরকে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। তারা খুব কমই পরিবারকে দেখতে যেতে পারেন। অর্থকষ্ট তাদের নিত্যদিনের জীবনকে এক কঠিন সংগ্রামে পরিণত করেছে।

জামালপুরের সানোয়ারা বেগম বর্তমানে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণে কর্মরত। তিনি বলেন, 'ভাড়ায় তিন হাজার টাকা চলে যায়। স্বামী ঢাকার একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কিন্তু আমার কর্মস্থল দূরে হওয়ায় তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার সঙ্গে থাকতে এসেছেন। এখন সংসার সামলানো আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।'

২০১৯ সাল থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দির একটি এমপিওভুক্ত স্কুলে পড়ান ইমরান হাসান। অন্যদিকে ঢাকার রামপুরায় আরেকটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। তারাও তাদের পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে যোগ দিয়েছেন এই আন্দোলনে।

ইমরান বলেন, 'আমার বাবা-মা খুলনায়, স্ত্রী ঢাকায়, আমি কুমিল্লায়। তিনটা সংসার চালাতে হয়। কোনো সঞ্চয়ের কথা ভাবতেই পারি না আমরা।'

ইমরান আরও বলেন, 'কখনও কখনও ধার করতে হয়। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে ঋণ নিয়ে মাসের পর মাস ধরে তা শোধ করতে হয়। এটাই এমপিও শিক্ষকদের বাস্তবতা।'

পাশে বসা আরেক শিক্ষক যোগ করেন, 'যখন নিজের পরিবারকে খাওয়াতে পারি না, তখন ছাত্রদের ওপর মনোযোগ রাখা কঠিন হয়ে যায়।' কণ্ঠে ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের সন্তানদের পুষ্টিকর খাবার দিতে পারি না, নতুন কাপড় কিনতে পারি না, অসুস্থ হলে ভালো ডাক্তারও দেখাতে পারি না। আমাদের অনেকেই ছোট আর স্যাঁতসেঁতে ঘরে থাকি।'

এসময় পাশে থাকা আন্দোলনরত শিক্ষকরা স্লোগান দিচ্ছিলেন, 'আমরা ভিক্ষা চাই না, চাই মর্যাদার জীবন।'

এর আগে গত ১২ অক্টোবর সারা দেশ থেকে আসা এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়েছিল। ওইদিন পুলিশ জলকামান, লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

এরপর শিক্ষকরা শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন এবং পুলিশি হামলার প্রতিবাদে পরদিন থেকে দেশব্যাপী কর্মবিরতির ঘোষণা দেন।

আটদিন ধরে তারা শাহবাগ অবরোধ করে রাখেন, এমনকি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে পদযাত্রার হুমকিও দেন।

১৭ অক্টোবর থেকে শিক্ষকরা আমরণ অনশন শুরু করেন। ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা।

মন্তব্য করুন


Link copied