স্টাফরিপোর্টার,নীলফামারী॥ গর্জে উঠেছে তিস্তা। প্রচন্ড স্রোত সামাল দিতে খুলে দেয়া হয়েছে নীলফামারীর ডালিয়াস্থ তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি স্লুইচ গেট। মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) রাত ৯টায় তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার (৫২.১৫) ৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
তিস্তাপাড়ের মানুষজন বলছেন, নদীর স্রোতের গর্জন ও চাপ অনেক। উজানের পাহাড়ী ঢলে তিস্তা নদীর পানির চাপে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার শিঙ্গিমারী ধুপড়ি চর এলাকার যাতায়াতের একমাত্র মাটির বাইপাস সড়কটি বিধ্বস্থ হয়ে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে বসতবাড়িতে প্রবেশ করছে। এতে বাড়িঘরে হাটু সমান পানিতে তলিয়ে গেছে।
চর এলাকার চলাচলের বাইপাস মাটির সড়কটি বিধ্বস্থ হওয়ায় চরাঞ্চলের সড়কপথে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। যোগাযোগের মাধ্যম হয়েছে নৌকা আর ভেলা। এছাড়া হু-হু করে পানি সমতলের বসতভিটায় প্রবেশ করায় সকলে নিরাপদ আশ্রয় দিকে যাচ্ছে। এদিকে উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ডুবে যেতে বসেছে আমন ধানসহ নানান ফসলের খেত। ভেসে যাচ্ছে চাষিদের পুকুরের মাছ।
ভারতের সিকিমের পাহাড়ে ও সমতলে ভারী বর্ষণসহ উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) বিকাল ৬টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমা (৫২.১৫) বরাবর প্রবাহিত হলেও রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলেন নিশ্চিত করেন ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশী অমিতাভ চৌধুরী। তিনি জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইচগেট খুলে রাখা হয়েছে। ফলে তিস্তা অববাহিকায় লালসংকেত জারী করা হয়েছে।
পাউবোর বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, উজানে ভারী বর্ষন ও পাহাড়িঢলে সকাল থেকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। সকাল ৬টা ও ৯টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯৭ সেন্টিমিটার। যা বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু বিকাল ৬টায় তা বিদৎসীমার ৫২.১৫ সেন্টিমিটার বরাবর প্রবাহিত হয়, এবং পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। রাত ৮টায় তা আরো ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৫২.২০ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হয়।
এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা উপজেলা, লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা, পাটগ্রাম, কালিগঞ্জ, আদিতমারী উপজেলার নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানা গেছে। তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ভাঙ্গনেরও আশংকা করা হচ্ছে। বেশকিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। তলিয়ে গেছে চরের সড়ক। ডুবে গেছে ওইসব এলাকার সবজিখেত। পানি বাড়লে বন্যার পরিধিও বাড়বে। পানি ঢুকবে নতুন নতুন এলাকা। চলতি বছর এবার তিস্তা নদীতে এখন পর্যন্ত বড় কোনো বন্যা হয়নি। এটি বন্যায় রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করছে তিস্তাপারের মানুষ। নদীতীরবর্তী অঞ্চলের জনগণকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে।
গড্ডিমারী ইউনিয়নের বাসিন্দা শামসুল আলম বলেন, উজান থেকে পানি আসছে। ইতিমধ্যে নিচু এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। নিচু এলাকার পরিবারগুলো পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। রাস্তঘাট ডুবে গেছে। গোবরধন গ্রামের আব্দুর রশিদ বলেন, উজানের ঢলে তিস্তার পানি বাড়ছে। যেভাবে পানি আসছে, তাতে বড় বন্যা হওয়ার ভয়ে আছি। এ বছর বড় কোনো বন্যা তো এখনো হয়নি।
ডিমলা উপজেলার পূর্বখড়িবাড়ি গ্রামের কৃষক আব্দুল খালেক জানান, কয়েকদিন ধরে পানি ওঠানামা করছে। আজ সন্ধ্যার পর থেকে পানি হু হু করে বাড়তে থাকে। রাত ১১টায় তা হাটু পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। রাতে হয়তো পানি আরও বাড়তে পারে। এখন পরিবার নিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তিনি বলেন, এবার চরের পাশে ৩ শতক জমিতে আমন ধানের চারা রোপন করেছি। সব তলিয়ে গেছে।
এদিকে ভারতীয় বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে- সিকিমে টানা ভারি বৃষ্টির মধ্যে তিস্তা নদীর পানি বিপজ্জনকভাবে বাড়তে থাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছে ভারতের আবহাওয়া দপ্তর। তিস্তা নদী ভারতের সীমানা পেরিয়ে নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফলে তিস্তার উজানে বন্যা দেখা দিলে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে। ভারতের তিস্তা নদীর দোমহনী পয়েন্টে সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত তিস্তার পানি বিপৎসীমার (৮৫.৯৫) ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে ভারতের কালিম্পং জেলার তারখোলার ১০ মাইল এলাকায় টানা বৃষ্টির জেরে ধস নামে। ১০ নম্বর জাতীয় সড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ধসের জেরে বিপাকে বহু যাত্রী, পর্যটক ও পণ্যবাহী গাড়ির চালক।
খবরে বলা হয় উত্তরবঙ্গে পাহাড়ি নদী তিস্তা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। প্রবল জলস্রোতে তিস্তার ধারে থাকা রাস্তা ও ব্রিজ কার্যত পানির তলায়। রবিঝোরা ও ২৯ মাইল এলাকায় ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে বইছে নদীর পানি। তিস্তা ব্রিজের সংযোগকারী কালিম্পং-দার্জিলিং রাস্তাা পুরোপুরি জলমগ্ন।আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, মঙ্গলবার ও বুধবার উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তিস্তা অববাহিকার দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারে কিছু কিছু জায়গায় ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সঙ্গে বজ্রপাত ও ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে বলে জানিয়েছে হাওয়া অফিস।তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় দোমহনী থেকে কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ পর্যন্ত তিস্তার অসংরতি অংশে লাল সতর্কতা জারি করেছে ভারতীয় সেচ দপ্তর বলে জানানো হয়।