নিউজ ডেস্ক:
দুই দিনের সফর শেষে গতকাল রাতে ঢাকা ত্যাগ করেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। গতকাল সকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তিনি। বৈঠকে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক বিনিময়, শিক্ষা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা এবং মানবিক বিষয়গুলোসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি সার্কের পুনর্জাগরণ ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়েও তারা আলোচনা করেন। এ সময় বহুমুখী নিবিড় সম্পর্ক উন্নয়নে ঐকমত্য হন। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে, শনিবার ঢাকায় নেমেই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেন তিনি।
ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকাল পৌনে নয়টায় রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীনের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠক করেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। বৈঠকে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে ছিলেন- বিডার চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান, বাণিজ্য ও শুল্ক কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান প্রমুখ।
এরপর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে প্রথমে একান্তে এবং পরে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠক অংশ নেন ইসহাক দার। এ বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত ইস্যুসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি, চারটি সমঝোতা স্মারক এবং একটি কর্মসূচি স্বাক্ষর করা হয়। এরপর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের আমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন ইসহাক দার। মধ্যাহ্নভোজ শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আমিরের বাসভবনে যান পাকিস্তানি উপ-প্রধানমন্ত্রী। এরপর বিকালে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যান তিনি। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সবশেষ সন্ধ্যা ৭টায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে তার গুলশানের বাসভন ফিরোজায় যান পাকিস্তানি উপপ্রধানমন্ত্রী। এরপর রাতে দুই দিনের সফর শেষে জেদ্দার উদ্দেশে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সই হওয়া চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে, ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ চুক্তি; দুই দেশের বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন; ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা; রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার (বাসস ও এপিপিসি) মধ্যে সহযোগিতা; বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সঙ্গে পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদের (আইএসএসআই) সহযোগিতা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সংস্কৃতিবিনিময় কর্মসূচি (সিইপি) সই হয়েছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে ইসহাক দার সাংবাদিকদের বলেন, একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত তিনটি ইস্যু দুইবার সমাধান হয়েছে। ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। ওই সময়ের দলিলটি দুই দেশের জন্য ঐতিহাসিক। এরপর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশে এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে বিষয়টির সমাধান করেছেন। ফলে বিষয়টির দুবার সমাধান হয়েছে। একবার ১৯৭৪ সালে, আরেকবার ২০০০ সালের শুরুতে।
এ সময় মন থেকে অতীতের স্মৃতি মুছে ফেলে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, মুসলমানদের তাদের হৃদয় পরিষ্কার রাখতে বলা হয়েছে। সুতরাং চলুন সামনে এগিয়ে যাই। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। এ সময় তিনি অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে ইসহাক দারের বক্তব্যের সঙ্গে ঢাকা একমত নয় বলে জানান। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমি অবশ্যই তার দাবির সঙ্গে একমত নই। একমত হলে তো ইস্যুগুলো সমাধান হয়ে যেত তাদের মতো করে। বৈঠকে আমরা আমাদের অবস্থান বলেছি, ওনারা ওনাদের অবস্থান বলেছে। আমরা চাই যে হিসাবপত্র হোক এবং টাকা-পয়সার বিষয়টি সমাধান হোক। ১৯৭১ সালে এখানে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটির বিষয়ে তারা দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাক এবং আটকে পড়া মানুষগুলোকে তারা ফেরত নিয়ে যাক। তিনি বলেন, ৫৪ বছরের অমীমাংসিত ইস্যু এক বৈঠকেই সমাধান করা বেশ কঠিন। তবে আমরা পরস্পরের অবস্থান তুলে ধরেছি। দুই পক্ষই এ বিষয় একমত হয়েছি যে, এ অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সমাধান করতে হবে, যাতে এগুলো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। বিগত সরকারের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ইচ্ছাকৃতভাবেই পিছিয়ে রাখা হয়েছিল। বর্তমান সরকার চায় পাকিস্তানের সঙ্গে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে, যেমনটি অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশের সঙ্গে রয়েছে। আমরা পারস্পরিক সম্মান, সমঝোতা এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে এ সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে চাই।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফিরোজায় যান পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে, জামায়াত আমিরের সঙ্গে পাকিস্তানি উপপ্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ শেষে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সাংবাদিকদের বলেন, মুসলিম দেশগুলোর ওপর যে জুলুম অত্যাচার চলছে সে বিষয়ে কথা বলেছেন জামায়াত আমির। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নয়ন সম্ভব সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সাক্ষাৎকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী তারিক বাযওয়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল (সাউথ এশিয়া ও সার্ক) ইলিয়াস মেহমুদ নিজামী, ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার, ডেপুটি হাইকমিশনার মুহাম্মাদ ওয়াসিফ, পলিটিক্যাল কাউন্সেল কামরান দাঙ্গল, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, জামায়াত আমিরের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
খালেদা জিয়া ও ইসহাক দারের সাক্ষাৎ : সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় সফররত পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবন ‘ফিরোজা’য় যান ইসহাক দার। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার।
৪৫ মিনিট স্থায়ী এই বৈঠকে বিএনপির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী (পিএস) এ বি এম আবদুস সাত্তার। অন্যদিকে পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দারসহ ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল ছিল দেশটির পক্ষ থেকে।
বৈঠক শেষে ডা. জাহিদ বলেন, ভবিষ্যতে পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের সম্পর্ক কীভাবে স্বাভাবিক করা যায়, এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে পাকিস্তান। এ ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়েছে।
অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ বলেন, ‘আপনারা জানেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ, বাসায় আছেন। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করেছেন তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তিনি মূলত এসেছিলেন। তাঁর আশু আরোগ্য কামনা করেছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পক্ষ থেকে ম্যাডামকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন উপপ্রধানমন্ত্রী।
সাক্ষাতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন, দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা ফোরাম সার্ককে শক্তিশালী করা- প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। তবে দেশের রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা হয়নি। একজন আরেকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। ম্যাডামের সুস্থতা কামনা করেছেন।’
এর আগে ২০১২ সালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানী খা ঢাকা সফরকালে গুলশানের বাসায় বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
শনিবার দুই দিনের সফরে একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছান ইসহাক দার। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়াম। ঢাকায় অবস্থানকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেন তিনি।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গেও আলাদা আলাদা বৈঠক করেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী। প্রায় ১৩ বছর পর কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলেন। যা পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।