উত্তর বাংলা ডেস্ক : আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন-এ প্রশ্ন নিয়েই যাত্রা করল নতুন স্বপ্নের নতুন বছর ২০২৫। আজ সকালের নতুন সূর্য অবারিত সম্ভাবনা বয়ে নিয়ে আসবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য। বছরের শেষ ধাপে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, এ প্রত্যাশায় খ্রিস্টীয় নতুন বছরকে স্বাগত জানাবে বাংলাদেশের মানুষ।
প্রবাদ আছে, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ।’ এটা বলা হয়, ভবিষ্যতের শঙ্কা থেকে। নতুন বছরে আমরা এমন কোনো আশঙ্কা করতেই চাই না। আমরা গণতন্ত্র, আইনের শাসন নিশ্চিত করার পথে এগোতে চাই। দলমতনির্বিশেষে সাম্য ও মর্যাদা নিয়ে বঁাঁচতে চাই। এটি নিশ্চিত করতে পারে একটি জবাবদিহিমূলক নির্বাচিত সরকার। গ্রহণযোগ্য ভোটের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের জনগণের প্রতি যে দায়বদ্ধতা থাকে, অনির্বাচিত সরকারের কাছে তা প্রত্যাশা করা যায় না। বিগত প্রায় পাঁচ মাসে এর প্রমাণ পেয়েছে দেশের মানুষ। নিত্যপণ্যের বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানি বেড়ে গেছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সরকারের সামনে দাবির মিছিল। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবি আদায়ের সমাবেশে সড়ক বন্ধ, যানজট বাড়ছে নগরীতে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে এবং অভাবনীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্র মেরামত ও জনগণের সেবা পাওয়ার মান উন্নত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে শঙ্কার কথা, মানুষ দ্রুতই ধৈর্য হারিয়ে ফেলতে পারে; যদি না শিগগিরই তাদের জীবন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় পরিবর্তন আসে। নতুন বছরে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে সরকারকে। গতকাল ছিল ডিসেম্বরের শেষ দিন, বছরেরও। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৫টি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট সরকারের কাছে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ দিনে রিপোর্টগুলো জমার নতুন তারিখ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের সম্ভাব্য একটি প্রস্তাব নিয়ে এখন অংশীজনদের মধ্যে তুমুল বিবাদ চলছে। অন্যদিকে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার কাজ শেষ করার পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বক্তব্য আসায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সরকার কি নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণের নীতি গ্রহণ করেছে? বছরের শেষ দিনে গতকাল রাজধানীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালন করে। এ সমাবেশ থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ উপস্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু আগের দিন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরপর শিক্ষার্থীরা পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচিতে পরিবর্তন এনে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালন করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বড় সুযোগ স্বৈরাচারবিরোধী জাতীয় ঐক্য অটুট রেখে দেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির মহাসড়কে তুলে দেওয়া। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের অবাধ দুর্নীতিতে স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাসের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, এসবের প্রতি সরকারের মনোযোগ তুলনামূলক কম। সরকারের আগ্রহের তালিকায় গুরুত্ব পাচ্ছে অন্য সব বিষয়। তার পরও সাধারণের ভাবনায়, এক সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা নতুন বছর ২০২৫ সালে।
যদিও বিগত দিনগুলোতে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির কারিগর ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিতে পারেনি। বরং নানানরকম বৈরী আচরণের মধ্য দিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য স্থবির করে দিয়েছে। যেসব ব্যবসায়ী হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে শিল্প গড়েছেন, যারা লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন, তাদের উপেক্ষা করে চলেছে অন্তর্বর্তী সরকার। অনেক ব্যবসায়ীকে উদ্দেশ্যমূলক মামলায় জড়ানো হয়েছে। উদ্যোক্তাদের হয়রানির কারণে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে গেছে। ফলে দেশজুড়ে শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছে। একটা দেশ চালাতে গেলে সব মত-পথের মানুষকে আস্থায় নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হয়। সমাজে বিভাজন বাড়িয়ে সামনে এগোনো যায় না। নিশ্চয় নতুন বছরে সরকার ব্যবসায়ীদের আরও আস্থায় নেবে।
২০২৫ হবে রাজনীতির আলোচিত বছর। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ইতিহাসের অমোঘ প্রয়োজনে কে কখন অনিবার্য হয়ে উঠবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, একসময়ের বিকল্পহীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখন গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে দেশছাড়া। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বর্তমানে ভারতে আশ্রিত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। ক্ষমতা ও রাজনীতিতে অপরিহার্য বলে কিছু নেই। সরকারের একটা অংশ বলছে, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের পর হবে নির্বাচন। একটা বিচার শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। ওই দীর্ঘ সময় মানুষ কেন অপেক্ষা করবে? বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, জাতীয় পার্টিসহ স্বৈরাচারের সহযোগীরা নির্বাচন করতে পারবে না। দেশের অন্তত এক তৃতীয়াংশ কর্মী-সমর্থক ও মানুষকে নির্বাচনের বাইরে রেখে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন করে ফেলা সহজ কাজ নয়। অতীতে আওয়ামী লীগ বিতর্কিত যে কাজ করে গেছে সেই স্বৈরতান্ত্রিক পথে কেন পা বাড়াতে হবে? দেশের অধিকাংশ মানুষ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য চায়। নতুন বছরে একটি সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় নির্বাচনের দিকে যেতে চায়। সবাই চায় দেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে নতুন স্বপ্ন বিনির্মাণ করে দেবে অন্তর্বর্তী সরকার।