আর্কাইভ  শনিবার ● ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ● ৮ আশ্বিন ১৪৩০
আর্কাইভ   শনিবার ● ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: সুযোগ পেলেই জামায়াত স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হবে : রংপুরে মোজাম্মেল হক       জাতিসংঘে আজ বাংলায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী       খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি, সিসিইউতে স্থানান্তর       ঘরের মেঝেতে কান্না করছে শিশু, বিছানায় মায়ের নিথর দেহ       বৃষ্টি থাকবে আরও দুই দিন      

উত্তরবঙ্গে চলছে রেলওয়ের কর্মযজ্ঞ

শুক্রবার, ৫ আগস্ট ২০২২, দুপুর ১১:০৯

ডেস্ক: পুরো দেশের রেলপথ এক সুতোয় গাঁথতে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে উত্তর জনপদে চলছে নতুন রেলপথ সংযোজনের কর্মযজ্ঞ। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়েছে অনেকখানি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পথ হিসেবে ভারতের সঙ্গে রেলসংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে নীলফামারীর চিলাহাটী এবং সীমান্তে ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজও চলছে। অন্যদিকে ভারতের ফুলবাড়ী অংশে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করছে দেশটির রেল বিভাগ।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, এখন চলছে রেলের ৩৬টি প্রকল্পের কাজ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে সোয়া এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে ১৫ নম্বর মেগা প্রকল্পটি বঙ্গবন্ধু রেল সেতু। প্রাথমিকভাবে ওই সেতুর অনুমোদিত নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। উদ্বোধনের আগে নির্মাণ খরচ বেড়ে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা করা হয়। এর মধ্যে জাপানি আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকা ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে। বাকি টাকা বাংলাদেশের। রেল সেতুটি নির্মাণ হলে একদিকে যেমন উত্তরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের সূচনা হবে, তেমনি খুলবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার আরেক দুয়ার।

যমুনায় মহাকর্মযজ্ঞ :টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ সীমান্তে ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হলে রাজধানীর সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ শুরু হয়। তবে ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ার পর ট্রেনের গতি কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। এতে সময়ক্ষেপণসহ শিডিউল বিপর্যয়ে যাত্রীরা প্রায়ই ভোগান্তিতে পড়েন। এরপরই বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা সামনে আসে। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর ওই সেতু নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই রেল সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে থাকবে নতুন স্টেশন ভবন, ইয়ার্ড রিমডেলিং ও রেলওয়ে সেতু মিউজিয়াম।

গত জুন পর্যন্ত এই রেল সেতুর কাজের অগ্রগতি ৪২ শতাংশ। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দুই লাইনের ডুয়েলগেজের এই সেতুর ৫০টি পিলারের মধ্যে ৩৮টির পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু দিয়ে এখন ৩৮টি ট্রেন চলাচল করতে পারে। বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ হলে প্রতিদিন ৬৮টি রেল চলতে পারবে।

এখন বঙ্গবন্ধু সড়ক সেতুর রেলপথে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারে। নতুন রেল সেতু দিয়ে ট্রেন চলতে পারবে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার বেগে। এটির ওপর দিয়ে যে কোনো ওজনের মাল ও যাত্রীবাহী ট্রেন যেতে পারবে। সাধারণত মালবাহী ট্রেনগুলোকে প্রায়ই দুটি ইঞ্জিন দিয়ে টানতে হয়। বর্তমান সড়ক সেতুর রেলপথের ওপর দিয়ে সেটি সম্ভব হয় না। ইঞ্জিন মেরামত করার জন্য সেটিকে অন্য আরেকটি ইঞ্জিন দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও বঙ্গবন্ধু সেতুতে নেই। যে কারণে পার্বতীপুরের কারখানায় মেরামতের জন্য ইঞ্জিন নেওয়া সম্ভব হয় না। এই রেল সেতু হলে সেটি সম্ভব হবে।

যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ ঘিরে এখন প্রকল্প এলাকায় চলছে মহাকর্মযজ্ঞ। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে সেখানে দিন-রাত চলছে কাজ। প্রকল্পে কাজ করছেন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। ২০২১ সালের মার্চে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়। এরই মধ্যে শেষ হওয়া পিলারগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। তবে মাঝামাঝি পর্যায়ে সিরাজগঞ্জ অংশে বাদ রয়েছে আটটি পিলারের পাইলিং।

কাজের অগ্রগতি বেশ ভালো জানিয়ে প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, '২০২৪ সালের ১০ আগস্ট নির্ধারিত সময়ে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে আশা করছি। এই সেতু তৈরিতে যেসব উপকরণ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা একটু আলাদা। এটি ওয়েদারিং স্টিল দিয়ে তৈরি করার কারণে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রায় শূন্য। রেললাইনগুলোয় চাকার ঘর্ষণে ক্ষয়ে যাওয়া কমাতে বিশেষ উপকরণ ব্যবহার করা হবে।' তিনি বলেন, 'সেতুর সংযোগস্থলে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, তাতে ব্রিজটির নিজের ওজন কম হবে। এত উচ্চপ্রযুক্তি দেশের অন্য কোনো রেল সেতুতে নেই।'

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবীর জানিয়েছেন, রেল সেতু হলে নতুন পথ চালু করা হবে। বর্তমানে যে রেল সেতুগুলো রয়েছে তাতে একটি করে লাইন রয়েছে। এই সেতুতে দুটি রেললাইন বসবে। ফলে কোনো ট্রেনকে সেতু পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।

তিনি বলেন, 'একটি রেল সেতু দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক উন্নতির পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে সংযুক্ত করবে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ। এই সেতু ভবিষ্যতে সেই সংযোগ তৈরি করতে সহায়তা করবে। এ লক্ষ্য নিয়ে উত্তরের সীমান্ত এলাকায় রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ চলছে।'

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ :এ বছরের মধ্যেই বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হচ্ছে। ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় পুরো প্রকল্পে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা খরচ করা হবে। এরই মধ্যে রেলপথের কোথায় কোথায় ব্রিজ, ফ্লাইওভার ও আন্ডারপাস নির্মাণ হবে- তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।

রেল সূত্রে জানা যায়, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথে সাতটি স্টেশন থাকবে। এগুলো হলো- বগুড়ার রানীরহাট, শাজাহানপুর, আড়িয়াবাজার, শেরপুর; সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, চান্দাইকোনা ও কৃষাণদিয়া। রেলওয়ে জংশন নির্মাণ করা হবে সিরাজগঞ্জে। এ প্রকল্পের কারণে উত্তরের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে রাজধানীর প্রায় ৭২ কিলোমিটার পথ কমবে। বর্তমানে বগুড়ার সান্তাহার জংশন হয়ে নাটোর, পাবনা, ঈশ্বরদী, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ঘুরে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৌঁছাতে হয়। শুধু বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিনটি জেলার পথ ঘুরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৌঁছাতে সময় লেগে যায় তিন থেকে চার ঘণ্টা। প্রায় ৪০৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লাগে ৯ ঘণ্টা। অন্যদিকে, সড়কপথে ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাসে করে ঢাকা যেতেও সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। অথচ বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু রেল সেতু দিয়ে সরাসরি ট্রেনযোগে পৌঁছাতে সময়ে লাগবে মাত্র এক থেকে সোয়া এক ঘণ্টা।

রেলের চলমান প্রকল্প: বঙ্গবন্ধু রেল সেতু ঘিরে এ অঞ্চলের রেল ব্যবস্থায় বইছে সুবাতাস। রেলের মেগা প্রকল্পের বেশিরভাগই এ অঞ্চলে। এখানে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভারতের সঙ্গে রেলসংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে চিলাহাটী এবং সীমান্তের মধ্যে ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ, বগুড়া থেকে শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন, সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ, জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ, পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর, খুলনা-দর্শনা জংশন সেকশনে ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সিগন্যালিংসহ রেললাইন সংস্কার ও নির্মাণ, দর্শনা থেকে দামুড়হুদা ও মুজিবনগর হয়ে মেহেরপুর পর্যন্ত নতুন ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও ডিজাইন, রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের লেভেলক্রসিং গেটগুলোর পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য।

ইকোনমিক জোন ও শিল্প পার্ক: রেল সেতুর কোলঘেঁষে সিরাজগঞ্জে গড়ে উঠছে ইকোনমিক জোন ও বিসিক শিল্প পার্ক। বিশাল আয়তন নিয়ে এই দুই প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ইকোনমিক জোনের আয়তন ১০ দশমিক ৩৫৯৩ একর। ব্যক্তিমালিকানাধীন ১১টি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে ৭০০টির মতো ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সুবিধার পাশাপাশি জল, স্থল ও রেলপথে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের ব্যাপক সুবিধা থাকছে।

একইভাবে রেল সেতুর পাশেই গড়ে উঠছে বিসিক শিল্প পার্ক। এটির নির্ধারিত স্থানে মাটি ভরাটের কাজ শেষ পর্যায়ে। চারদিকে প্রাচীর ও অফিস নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৩ সালে এখানে কারখানা নির্মাণের জন্য ব্যবসায়ীদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে।

রেলমন্ত্রী যা বলছেন: রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, '২০২৪ সালের মধ্যে আমরা যমুনা রেল সেতু চালু করতে পারব। আশা করছি, শুরুতেই পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চলাচল করবে। এ বছরের মধ্যেই খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত রেল চালু হবে। এ ছাড়া ডিসেম্বরের মধ্যে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডাবল এবং কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত থার্ড লাইন ফোর লাইনে বর্ধিত করার কাজ শেষ হবে। সব মিলিয়ে রেল চলাচলে একটা বড় পরিবর্তন আসছে। খবর-সমকাল

মন্তব্য করুন


 

Link copied