ডেস্ক: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪-দলীয় জোটের শরিক ও জাতীয় পার্টির (জাপা) মোট ৩২ আসনে সমঝোতা হয়েছে। তবে এই সমঝোতার প্রতিফলন মাঠে না দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন জোট শরিক ও জাপার নেতারা। ১৪ দলের শরিকরা জনসভায় গিয়ে নৌকার জন্য ভোট চাইলেও জোট ও জাপার প্রার্থীরা আওয়ামী লীগ থেকে একই সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তুলছেন তারা।
তারা বলছেন, নৌকার প্রার্থীদের আপাতদৃষ্টিতে সরিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দিলেও আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বীরদর্পে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
অভিযোগ আছে, সমঝোতার আসনগুলোতে যারা নৌকার প্রার্থী ছিলেন, তারা প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর কার পক্ষ নেবেন বা করণীয় কী- এ ব্যাপারে তাদের কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে অনিশ্চয়তা নিয়েই ভোটের মাঠে লড়ছেন সমঝোতার আসনের জোট শরিক ও জাপার প্রার্থীরা। সেই অনিশ্চয়তা থেকেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ভোটের মাঠে তার দল থাকবে কিনা তা নিয়ে শেষ মুহূর্তেও সংশয় প্রকাশ করেছেন। এমন বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি চান জোট শরিক ও জাপার এসব প্রার্থী।
এদিকে আওয়ামী লীগের আসনগুলোতে জাপা ও জোটের শরিক দলের প্রার্থী থাকার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করেন, এই সব দলের প্রার্থীদের নৌকার প্রার্থীকে হারানোর ক্ষমতা নেই। তবে তারা থাকলে ভোটার উপস্থিতিতে সহায়ক হবে।
জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কিনা- গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘নির্বাচন না আসা পর্যন্ত সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকব কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।’
আওয়ামী লীগ সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন দেয়। জিএম কাদের রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে তার স্ত্রী শেরিফা কাদের ঢাকা-১৮ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। ওই আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। জানা গেছে, এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আছেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থানে। দলের সিদ্ধান্তে শেরিফা কাদেরের বিপরীতে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। তবে দল থেকে ভোটের মাঠে তার করণীয় নিয়ে তাকে কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি বলে আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে। অথচ এ আসনে জাপার প্রার্থী শেরিফা কাদেরকে জয়ী হতে হলে অবশ্যই বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসানের সমর্থন লাগবে বলে স্থানীয়রা মনে করেন।
জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া ২৬ আসনের মধ্যে বাকি ২৪টি আসনের প্রার্থীরা হচ্ছেন ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মো. মুজিবুল হক চুন্নু, রংপুর-১ আসনে হোসেন মকবুল শাহরিয়ার, নীলফামারী-৪ আসনে আহসান আদেলুর রহমান, কুড়িগ্রাম-১ আসনে মুস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম-২ আসনে পনির উদ্দিন আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে সেলিম ওসমান, গাইবান্ধা-১ আসনে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গাইবান্ধা-২ আসনে মো. আব্দুর রশিদ সরকার, সিলেট-৩ আসনে মো. আতিকুর রহমান, নীলফামারী-৩ আসনে রানা মোহাম্মদ সোহেল ও বগুড়া-৩ আসনে নুরুল ইসলাম তালুকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম-৮ আসনে সুলেমান আলম শেঠ, বগুড়া-২ আসনে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, সাতক্ষীরা-২ আসনে মো. আশরাফুজ্জামান, ফেনী-৩ আসনে মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৫ আসনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পটুয়াখালী-১ আসনে রুহুল আমিন হাওলাদার, ময়মনসিংহ-৫ আসনে সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি, ময়মনসিংহ-৮ আসনে ফখরুল ইমাম, পিরোজপুর-৩ আসনে মো. মাশরেকুল আজম রবি, হবিগঞ্জ-১ আসনে মো. আব্দুল মুনিম চৌধুরী, মানিকগঞ্জ-১ আসনে জহিরুল আলম রুবেল ও বরিশাল-৩ আসনে গোলাম কিবরিয়া টিপু।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব প্রার্থীর মধ্যে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে আছেন জিএম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও আদেলুর রহমান। তারা মূলত আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলের কারণে জয়ী হয়ে যেতে পারেন। অন্য প্রার্থীদের আওয়ামী লীগ পূর্ণ সমর্থন না দিলে তাদের অনেকেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
জাতীয় পার্টির এক প্রার্থীর ভাষ্য, এটা সবারই জানা যে, এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের পাশে না থাকলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সুতরাং জাপার প্রার্থীদের জয়ের নিশ্চয়তা না দিলে তারা শেষ মুহূর্তে মাঠ ছেড়ে দিতে পারেন এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। তার ভাষ্য, জাপাকে জয়ী করে না আনলে নির্বাচনপরবর্তী সময়ে বিরোধী দল গঠন কীভাবে হবে তাও ভাবার বিষয়।
১৪ দলের শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি আসন পেয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল-২ আসনে রাশেদ খান মেনন ও রাজশাহী-২ আসনে ফজলে হোসেন বাদশা রয়েছেন। জাসদ পেয়েছে তিনটি আসন। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-২ আসনে হাসানুল হক ইনু, লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে মোশারফ হোসেন ও বগুড়া-৪ আসনে এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন। জেপি পিরোজপুর-২ আসন পেয়েছে। সেখানে প্রার্থী হয়েছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
এসব আসনের বিভিন্ন পর্যায়ের ভোটার ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়া তাদের বিজয়ী হওয়ার সুযোগ খুব একটা নেই। সে কারণে এসব প্রার্থী আওয়ামী লীগের কাছে শুধু সমঝোতাই নয়, জয়ের নিশ্চয়তাও চান। এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে তারা ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
জানা গেছে, তুলনামূলকভাবে বরিশাল-২ আসনে রাশেদ খান মেনন ও কুষ্টিয়া-২ আসনে হাসানুল হক ইনুর অবস্থান অন্যদের তুলনায় ভালো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৪-দলীয় জোট শরিকদের এক প্রার্থী বলেন, ‘সমঝোতার মাধ্যমে আসন দিয়ে পাশে না থাকাটা রসিকতার পর্যায়ে পড়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন আচরণে আদর্শিক জোট ১৪ দলের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে ঠেকে তা বলা কঠিন।’
বরিশাল বিভাগে সমঝোতার আসনে আওয়ামী লীগের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন, ‘যেসব প্রার্থী সমঝোতার কোটায় মনোনয়ন নিয়েছেন তাদের ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য হওয়ার মতো গ্রহণযোগ্যতা নেই। অন্য দলের অনুকম্পা নিয়ে জয়ী হওয়ার বাসনা মন থেকে ত্যাগ করে মাঠে এলে পরিস্থিতিটা পুরোপুরি বোঝা যাবে।’
বরিশাল-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের নাতি ফাইয়াজুল হক রাজু। তিনি বলেন, ‘নৌকা প্রতীকে প্রার্থী দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন- যে কেউ নির্বাচন করতে পারবেন। দল থেকে আমার ওপর কোনো চাপ নেই। আশা করি ভোটাররা সুচিন্তিত মতামত দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হি?সে?বে আমাকে বিজয়ী করবেন।’
আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে শর্ত নিয়ে সমঝোতা হয়েছে তা বাস্তবায়ন আওয়ামী লীগ দেখিয়ে দিয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সরিয়ে দেওয়ার শর্ত সমঝোতার টেবিলে ছিল না।’
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলটির পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, জনগণের অংশগ্রহণই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সে বিবেচনায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং অন্যান্য দলের প্রার্থী না থাকলেও কেন্দ্রে ভোটার নেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। শেষ মুহূর্তে নৌকার প্রার্থীকে সমঝোতার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করা হতে পারে; কিন্তু ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সরানোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। খবর-আমাদের সময়