আর্কাইভ  রবিবার ● ৬ জুলাই ২০২৫ ● ২২ আষাঢ় ১৪৩২
আর্কাইভ   রবিবার ● ৬ জুলাই ২০২৫
ছুটির দিনেও রাজপথ ছিল অগ্নিগর্ভ

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
ছুটির দিনেও রাজপথ ছিল অগ্নিগর্ভ

৭ জুলাই ‘শ্রাবণ বিদ্রোহ’র প্রিমিয়ার শো

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
৭ জুলাই ‘শ্রাবণ বিদ্রোহ’র প্রিমিয়ার শো

১৯ জুলাই 'মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ দিবস' ঘোষণার দাবি

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
১৯ জুলাই 'মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ দিবস' ঘোষণার দাবি

হাসিনার মুখে ছিল এক কথা, ভেতরে অন্য চিত্র

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
হাসিনার মুখে ছিল এক কথা, ভেতরে অন্য চিত্র

জ্বালানি সংকট : উত্তরণে সাশ্রয়ের বিকল্প নেই

শনিবার, ২৩ জুলাই ২০২২, দুপুর ১০:২২

Ad

সৈয়দ ফারুক হোসেন

বিশ্বব্যাপী চলমান জ্বালানি সংকটে হু-হু করে বাড়ছে তেল-গ্যাসের দাম, যার প্রভাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহে। তবে এই সংকটের এখানেই শেষ নয়। অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। গভীরতা ও জটিলতার দিক থেকে এত বড় জ্বালানি সংকট এর আগে কখনো দেখেনি বিশ্ব। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়তো এখনো আসেনি। এই সংকটের জন্য বিশ্ববাজারে তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির চড়া দামকে দায়ী করছে সরকার। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সংকট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এই সংকট আরও বাড়তে পারে।

সংকটের মুখে সরকার এখন ডিজেলের ব্যবহার কমানোর ওপর জোর দিচ্ছে। জ্বালানি সংকট এখন সারাবিশ্বকেই ভোগাচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে টালমাটাল বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা। ওই সময় বিশ্বের বৃহত্তম তেল-গ্যাস রপ্তানিকারক ও নিত্যপণ্যের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী ছিল রাশিয়া। মূল্যবৃদ্ধির ফলে গ্যাসের ট্যাংক ভরা, ঘরবাড়ি গরম রাখা ও শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহের খরচ সারাবিশ্বেই বাড়ছে, যা মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এর ফলে আফ্রিকা থেকে শ্রীলংকায় বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে সংকটের সূচনা হয়েছে, তা নিয়ে ভাবনার বিষয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও বিতরণব্যবস্থা নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনায় কত টাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, কত টাকায় বিক্রি হয় এসব নিয়ে বিতর্ক চলছে। জ্বালানি খাতের এই সংকট ইতোমধ্যেই বাজারের ওপর এসে পড়েছে।

প্রায় এক বছর ধরেই দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে। শুধু বিদ্যুৎ আর জ্বালানি খাতে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে হয়। উত্তরণটা কবে হবে সেটা নির্ভর করছে ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর। সবাই সচেতন হলে মোকাবিলা সম্ভব। সেপ্টেম্বরে অনেকগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। রামপালের ইউনিট চালু হবে, আদানি গ্রুপের একটি, এস আলম গ্রুপের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিকে কেন্দ্র করে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, সেখানে উৎপাদন বাড়বে। ফলে সেপ্টেম্বরের পর দেশে হয়তো বিদ্যুতের সংকটটা থাকবে না। ইউরোপে এবারের শীতকাল খুব, খুব কঠিন হবে। এটি একটি বড় উদ্বেগ, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাথমিক পর্যায় থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার জ্বালানির চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং তার ওপর দিয়ে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী তীব্র জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এখন আমাদের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি থাকার পরও জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং আমরা আবারও কিছুটা লোডশেডিংয়ের মধ্যে পড়েছি। দীর্ঘ সময় ধরে জ্বালানির নজিরবিহীন উচ্চমূল্য এবং সরবরাহ ঘাটতি পুরো অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে উন্নত, উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশগুলো। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রেকর্ড পরিমাণ মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ ভুগছে। খাদ্য সরবরাহ, শিপিং স্পেস বা কনটেইনারের ঘাটতি এবং জ্বালানির দামসহ অন্যান্য সরবরাহ চেইন সমস্যার কারণে অনেক দেশই মন্দার সম্মুখীন হচ্ছে।

রাশিয়া ইউরোপে ৪০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে। বিশ্বের অপরিশোধিত তেলের ১২ শতাংশও সরবরাহ করে এবং এর অর্ধেক যায় ইউরোপে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞাগুলোর কারণে বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশে সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে ইউরোপে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংল্যান্ড, স্পেন, নেদারল্যান্ডস এবং অন্যান্য দেশ দরিদ্র পরিবারগুলোকে সরাসরি ভর্তুকি দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বে কয়েকদিন ধরে একটি আলোচিত বিষয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট এবং এর ফলে সৃষ্ট মানুষের দুর্ভোগ। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং এর পাশাপাশি দেশে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে ডিজেলের রেশনিং করতে হচ্ছে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২৩০০ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে কাতার থেকে ৫০০ ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। ফলে চাহিদার বিপরীতে ৭০০ ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকছে। এই চাহিদা মেটানো হতো আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে আমদানি করে। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব ধনী দেশগুলোতেও পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির দেশ অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে। আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণ বিক্ষোভ করছে। আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বজুড়ে ২৩০ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হতে পারে। ইউক্রেনের রপ্তানি যুদ্ধ-পূর্ব পর্যায়ে ফিরিয়ে নেওয়া না গেলে পুরো বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে। ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের সরবরাহ কমে গেছে। বেড়েছে বিকল্প খাদ্যপণ্যের দাম।

জাতিসংঘের মতে, দেশটি এক ভয়াবহ মানবিক সংকটে পড়েছে। জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় পেট্রল বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে অর্থাৎ শ্রীলংকার জনগণ এখন খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ থেকে কবে উত্তরণ ঘটবে, তা বলা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে জ্বালানি সংকট দেখা দেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। সরকারকে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে সামনে অর্থনৈতিক সংকট ধেয়ে আসছে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। শ্রীলংকার মতো উপসর্গ রয়েছে বলেও তারা বলেছেন। তবে শ্রীলংকায় যেভাবে হঠাৎ করে ধস নেমেছে, সেভাবে না হলেও ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যেতে পারে বিশ্বের অনেক দেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসার পরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে পঙ্গু করে তুলেছে। অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি জ্বালানি। এর সংকট হলে যোগাযোগব্যবস্থা, কৃষি ও উৎপাদন খাতে স্থবিরতা নেমে আসে।

বাংলাদেশের বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকিতে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জ্বালানি কিনলেও সেই দামে দেশের গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে না সরকার। কারণ তাতে সাধারণ মানুষের ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাবে এবং অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার প্রবণতাও বাড়বে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৫৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দেয় সরকার। ভর্তুকি না দিলে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কত হতো তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। এদিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইউরোপ এক অভূতপূর্ব সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। বৈশ্বিক সংকট, মহামারী, মন্দা সত্ত্বেও সরকার কখনো তার মূল আদর্শ থেকে একচুলও নড়েনি। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সরকার মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মার্কেট চরম অস্থিতিশীল হওয়ার পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি যাতে বড় ধরনের কোনো ক্ষতির সম্মুখীন না হয়; সে লক্ষ্যে সরকার আগেভাগেই কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। করোনা সংকট মোকাবিলায় যেখানে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ হিমশিম খেয়েছে, সেখানে সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করোনা সংকট মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। সবাইকে নিজ দায়িত্বে সাশ্রয়ী হতে হবে। এটা সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রী বলেছে বলে নয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজ দায়িত্ব থেকে এখন সাশ্রয়ী হতে হবে। এর জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে যেমন- ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস-আদালতে কিংবা বাসায় এসি ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামানো যাবে না। আলোকসজ্জা আপাতত বন্ধ করতে হবে। বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে শেষ করতে হবে। বাজার, মসজিদ, শপিংমলে বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। আশা করি, আমরা সবার প্রচেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যেই এ সংকট থেকে উত্তরণ লাভ করতে পারব।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন


Link copied