মাহফুজা অনন্যা , লেখক : একজন নারীকে যখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিবস্ত্র করা হয়, তখন বিবস্ত্র হয় সমগ্র দেশ! আর ধর্ষণের শিকার শুধু একজন নারী হয় না, ধর্ষণের শিকার হয় পুরো জাতি! নির্যাতিত হয় বাংলাদেশ! ঐ নারীর বয়স, জাত, যাই হোক না কেন সবকিছুর আগে তিনি একজন নারী, একজন মেয়ে, একজন মা, একটি বাংলাদেশ– একটি পতাকা–একটি মানচিত্র! ধর্ষণকারী যেই হোক, যে জাতের হোক, যে ধর্মের হোক, যে দলের হোক তার একমাত্র পরিচয় সে ধর্ষক। একজন ধর্ষক মায়ের বিরুদ্ধে, বোনের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে, এককথায় সে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে!
সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরের ভাইরাল ভিডিও থেকে যা বোঝা যায়, ভুক্তভোগী ঐ নারীর পরিবার বেশ দরিদ্র, তার উপর হিন্দু সম্প্রদায়। ঐ নারীর মা তথাকথিত ধর্ষক ফজর আলীর কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। এবার নিশ্চয় বুঝতে আর কষ্ট হবে না আপনাদের। কারণে অকারণে ধর্ষক ফাঁদ পাততে থাকে এবং কুনজর পড়ে বৃদ্ধার মেয়ের দিকে। যেহেতু মায়ের অনেক টাকা ঋণ, তাছাড়া তারা জাতিগতভাবে দুর্বল, স্বামীও বিদেশ থাকে, এই সুযোগই কাজে লাগায় ধর্ষক ফজর আলী। একসময় মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেও রেহাই পায় না। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে ফজর আলী এবং তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে।
এমতাবস্থায় গ্রামের মানুষ দেখে ফেলে৷ চক্ষুলজ্জার ভয়ে হয়তো মেয়েটিও চিৎকার করতে ভেবেছে অনেকবার। আর তথাকথিত ইয়েলো সাংবাদিক ও বাংলাদেশের কিছু কুপরিপক্ক জনগণ মেয়েটির দোষ বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন, আপনার ঋণের বোঝার দায়ে যদি একইভাবে আপনার মেয়েকে এলাকার প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি একইভাবে ব্যবহার করে, তখন কেমন হবে বিষয়টা, একবার ভাবুন তো? আপনাদের মতো জনগণের ভয়েই কিন্তু ধর্ষকের মতো অপরাধীকেও মানুষ জনসম্মুখে আনতে দশবার ভাবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ঐ গৃহবধূকে শুধু ধর্ষণই করেনি, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেছে। সেটাকে অনেকেই ধামাচাপা দেবার জন্য, বিভিন্ন রকমের যুক্তি উপস্থাপন করছে। পরকীয়া, প্রবাসে স্বামী থাকে, হিন্দু আরও কত ধরনের যুক্তি। ধর্ষিতা যে ধর্মেরই হোক তার বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর ধর্ষক যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় এনে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। আগেও এ দেশের নিরাপদ ক্যান্টনমেন্টে তনুর বিবস্ত্র লাশ পড়ে থাকতে দেখেছে মানুষ। এ দেশে ধর্ষণের বিচার না পেয়ে হতাশায় গলায় ফাঁস নেয় কিশোরী! এর শেষ হোক! এর শেষ চাই!
দুঃখজনক হলেও সত্য—ধর্ষণের মতো অপরাধ নিয়েও সমাজের একাংশ এখন যুক্তির পসরা সাজাচ্ছে। কেউ বলছেন ভিকটিম পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলেন, কেউ বলছেন তার স্বামী প্রবাসে ছিলেন, আবার কেউ ধর্মীয় পরিচয় টেনে এনে মানবিকতা আড়াল করার অপচেষ্টা করছেন। চলছে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার উৎসব। কিন্তু আমরা মনে করি—ধর্ষিতা যে ধর্মের, যে শ্রেণির, যে অবস্থানেরই হোক না কেন, সে বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। তার সম্ভ্রমের ওপর চালানো এই নৃশংস হামলার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আর ধর্ষক—সে যেই হোক, যত প্রভাবশালী হোক না কেন, তার বিচার চাই এবং চাই দ্রুততম সময়ে ফাঁসির রায় কার্যকর হোক।
এই ধরনের জঘন্য অপরাধের বিচার যদি দৃষ্টান্তমূলক না হয়, তবে সমাজে ধর্ষকদের সাহস আরও বাড়বে, নারীরা আরও অনিরাপদ হবে। আমরা চাই, আইন হোক কঠোর, বিচার হোক দ্রুত, আর অপরাধী হোক শাস্তির মুখোমুখি—ধর্ম, পরিচয় কিংবা অবস্থান যাই হোক না কেন। এই সমাজে ধর্ষক শুধু একজন ব্যক্তি নয়, বরং এক ধরনের মনোভাবের প্রতিনিধি। তারা হয়তো পাশের মানুষ, আত্মীয়, শিক্ষক, নেতা, এমনকি পরিবারে বিশ্বাসভাজন কেউ — কিন্তু তারা একেকজন একেক রকম দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে, যা তাদের অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। ধর্ষক মনোভাবের পুরুষগণ মনে করেন নারী মানেই ভোগের বস্তু।
এদের দৃষ্টিতে নারী হলো শরীর মাত্র। নারীর সম্মান, অধিকার, ইচ্ছা, সবকিছু এদের কাছে মূল্যহীন। তারা মনে করে, সুযোগ পেলে নারীর শরীর ভোগ করা তাদের অধিকার। নারী যদি খোলামেলা পোশাক পরে, তবে তারাও দুর্বল হবে। এরা নারীকে দায়ী করে—“সে অমনভাবে না চললে, কিছুই হতো না।” নিজের অপরাধ ঢাকতে নারীর চলাফেরা, পোশাক বা আচরণকে টেনে আনে। তারা এও বলে–মেয়েটি প্রেমে সাড়া দেয়নি, তাই ওকে শিক্ষা দেওয়া উচিত। প্রেম প্রত্যাখ্যান করলেই এই শ্রেণির মানুষ মনে করে সে ‘অপমানিত’ হয়েছে। তাই প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ধর্ষণকে তারা ‘শাস্তি’ হিসেবে ব্যবহার করে।
একশ্রেণির পুরুষ মনে করে সে আমার বউ, ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই –এরা ভাবে, বিয়ে মানেই ভোগের অনুমতি। স্ত্রীর সম্মতি, শারীরিক–মানসিক অবস্থা—এসবের কোনো গুরুত্ব নেই তাদের কাছে। তারা মনে করে স্ত্রীর শরীর তার মালিকানাধীন। মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়নি, মেয়েটিরও মত ছিল। এরা অপরাধ ঢাকতে বলে, “সব ওর ইচ্ছাতেই হয়েছে।” ভিডিও শেয়ার করে, চেহারার ভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করে—যাতে করে প্রমাণ করতে পারে, নারী নিজেই দায়ী।
ধর্ষণের বিচার পেতে গেলে নারীকে যেতে হয় থানায়—সেখানে পুরুষ অফিসারের কাছে বিবরণ দিতে হয় নিজের দেহের চরম অপমানের। তারপর যেতে হয় হাসপাতালে, যেখানে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নামে এখনো অবমাননাকর কিছু পরীক্ষা চলে। এরপর শুরু হয় আদালতের দীর্ঘ নাটক, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, আইনজীবীর ‘চরিত্র হনন’ প্রশ্ন। বিচার শেষ হতে হতে নারীর আত্মবিশ্বাস চুরমার হয়ে যায়। ধর্ষণের মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা বরদাশতযোগ্য নয়।
কেউ কেউ মনে করে টাকা আছে, ক্ষমতা আছে, কেউ কিছু করতে পারবে না। এরা প্রভাবশালী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, গডফাদার শ্রেণির। তারা জানে, টাকা দিয়ে পুলিশ কেনা যাবে, বিচার টানা যাবে, এবং ভুক্তভোগীকে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা যাবে। মেয়েটি তো ভিন্ন ধর্মের। ওর প্রতি সহানুভূতি কীসের? ধর্ষিতার ধর্ম, জাত, পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে ধর্ষকরা যেন অপরাধকে হালকা করে দিতে চায়। তারা জাতিগত বিদ্বেষের সুযোগ নিয়ে নারীর ওপর নৃশংসতা চালায়।
সবাই তো করছে। একটু আধটু করলে কী আর হবে? ধর্ষণের মতো অপরাধকে সাধারণ চোখে দেখা হচ্ছে। এই মানসিকতা ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে । পর্নে আসক্ত, বিকৃত কল্পনায় ঘেরা তরুণেরা ভাবে, ধর্ষণ একটা ‘স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা’। তারা অপরাধের ভয়ও পায় না। এইসব দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে দায়ী একটি বিষাক্ত সমাজব্যবস্থা, যেখানে নারীর নিরাপত্তা নয়, বরং ধর্ষকের 'সমাজ-ইজ্জত' রক্ষা করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো না বদলালে ধর্ষণের বিচার হলেও সমাজে ধর্ষণ বন্ধ হবে না।
"ধর্ষক" বলতে আমরা কাকে বুঝি? শুধু কি রাস্তায় ওৎ পেতে থাকা একজন অপরিচিত মানুষ, নাকি সেই মানুষটিকেও ধর্ষক বলা উচিত, যে নারীর ‘না’ কে কখনও সম্মতি হিসেবে মেনে নেয় না? প্রতিদিন সংবাদে আমরা ধর্ষণের ঘটনা দেখি। কিছু ঘটনায় চিৎকার ওঠে, কিছু ঘটনা নিঃশব্দে মাটিচাপা পড়ে যায়। কিন্তু খুব কম সময়েই আমরা চিন্তা করি—এই ধর্ষকদের জন্ম কোথায় হচ্ছে? তারা কি কোনো ভিন্ন গ্রহ থেকে আসে? না কি আমাদেরই সমাজ তাদের তৈরি করছে?
এই সমাজে ধর্ষকেরা লুকিয়ে থাকে বহু মুখোশে। কারও মুখে বড় বড় কথা, কারও পাঞ্জাবি পরা গা ছোঁয়ানো নীতি, কারও হাতে ক্ষমতার চাবি, কারও হাতে ভিডিও ক্যামেরা। তারা শুধু ধর্ষণ করে না, ধর্ষণের পর যুক্তি দাঁড় করায়।
একজন গৃহবধূ যদি ধর্ষণের শিকার হয়, তাহলে শুরু হয় যুক্তির স্রোত—
“স্বামী থাকে বিদেশে”,
“ও তো হিন্দু জাত”,
“ওর চালচলনই ঠিক ছিল না”।
এই সমাজ ধর্ষণের ঘটনাকে বিচার করার আগে ধর্ষিতাকে বিচার করে ফেলে। যেন শরীরের ওপর চালানো নৃশংসতা নয়, বরং তার পোশাকটাই বড় অপরাধ। ধর্ষকেরা ভাবেন, নারীর শরীর ভোগ করার জন্যই আছে, বিয়ের পর স্ত্রীর সম্মতি লাগে না, প্রেমে প্রত্যাখ্যান মানেই অপমান, ক্ষমতা থাকলে ধর্ষণ করলেও পার পাওয়া যাবে। তাদের এই মানসিকতাকে পুষ্টি দেয় সমাজের চুপ থাকা, পারিবারিক চুপচাপ মেনে নেওয়া, প্রশাসনের ঢিলেমি, এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
আজ আমরা যখন বলি “ধর্ষকের ফাঁসি চাই”, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে—ফাঁসি দিলে কী এই মানসিকতা মুছে যাবে? ফাঁসি অপরিহার্য, কারণ বিচারহীনতা অপরাধকে উৎসাহ দেয়। কিন্তু ফাঁসির পাশাপাশি দরকার সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন। দরকার শিক্ষা, সচেতনতা, সামাজিক প্রতিবাদ, এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ।
আমাদের ভাবতে হবে, ধর্ষক শুধু একজন মানুষ নয়—একটা মানসিকতা। আর এই মানসিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না হলে, মুখোশধারী ধর্ষকরা আরও ছড়িয়ে পড়বে—কখনও শিক্ষক হয়ে, কখনও বন্ধু, আত্মীয়, নেতা, আবার কখনও স্বামী হয়েও। যতক্ষণ না আমরা ধর্ষকের এই মনোভাবকে সমাজ থেকে উৎখাত করতে পারি, ততক্ষণ শুধু ফাঁসি নয়, প্রতিদিন ধর্ষণের নতুন নতুন গল্প শুনতেই হবে।
ধর্ষণের বিচার চাই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি চাই –এই মানসিকতার অবসান। আজকাল ধর্ষণ শব্দটি এত বেশি শুনতে হয় যে, এখন আর আমাদের চমকে দেয় না। যেন এটি প্রতিদিনের নৈমিত্তিক সংবাদ, একটি খবরের উপস্থাপন, একটি টেলিভিশন স্ক্রলের শব্দমাত্র। মাঝে মাঝে বড় ঘটনা হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ ওঠে, ‘ফাঁসি চাই’ লেখা পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে, কেউ কেউ প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটে। তারপর সব থেমে যায়। ধর্ষিতা নারীটি একসময় একা হয়ে যান না হয় আত্মহত্যা করে সমাজকে মুক্তি দেন। সমাজ নিজের মতো চলতে থাকে, আর ধর্ষক নতুন ছদ্মবেশে নতুন শিকার খুঁজে নেয়।
আমরা যদি ধর্ষক বলতে কেবল সেই মুখটিকে বুঝি, যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে; তাহলে আমরা অন্ধকারে রয়েছি। ধর্ষক কেবল একটি চেহারা নয়, সে একেক সময় একেক রূপে আসে—সে হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, হতে পারে বন্ধু, হতে পারে স্বামী, হতে পারে রাজনৈতিক নেতা, হতে পারে ইউটিউবার, আবার হতে পারে সেই পুলিশ সদস্য, যে নারীকে রক্ষা করার দায়িত্বে রয়েছে। কিন্তু সবাই ধর্ষক হয়ে ওঠে না। ধর্ষক হয়ে ওঠে তারা, যাদের মানসিকতায় বিকৃতি, দৃষ্টিভঙ্গিতে দম্ভ, আর হৃদয়ে নারী বিদ্বেষ। এই সমাজে ধর্ষকেরা একটি নির্দিষ্ট মানসিকতা পোষণ করে। তারা মনে করে—নারী=শরীর=ভোগের অধিকার নারীর আত্মা, চিন্তা, ইচ্ছা—এসব তাদের কাছে তুচ্ছ। সে চায় কি চায়না, সে রাজি কি রাজি না—এসবের হিসাব রাখে না তারা। তারা ভাবে, শক্তি থাকলেই নারীকে ভোগ করা যায়। নারীর পোশাককে দায়ী করে তারা।
অথচ ধর্ষণ হয় ৬ বছরের শিশুকন্যার ওপরও, ৭০ বছরের বৃদ্ধার ওপরও—যাদের পোশাকে ‘উস্কানি’ বলে কিছু নেই। বিয়ের পরে স্ত্রীর ‘না’ কে তারা কখনও গুরুত্ব দেয় না। স্ত্রীর দেহকে তারা নিজের সম্পত্তি ভাবে—কোনো সম্মতির প্রয়োজন পড়ে না। প্রত্যাখ্যান মানে অপমান—এই ধারণা থেকে অনেক ধর্ষক প্রতিশোধ নেয়। যাকে চায়নি সে, তাকে জোর করে দখল করলেই বুঝি নিজের পুরুষত্ব প্রমাণ হয়। জাতিবিদ্বেষী মানসিকতা থেকে অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হন শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে। একটি মেয়ে হিন্দু হলে বা সংখ্যালঘু হলে অনেকেই ভাবে—তার ওপরে অপরাধ করলেও সমাজ নীরব থাকবে। রাজনীতি, টাকা, ক্ষমতা—সব মিলিয়ে ধর্ষকেরা অনেক সময় নিজেদের ‘অপরাধমুক্ত’ মনে করে। থানায় মামলা নেয় না, হাসপাতাল রিপোর্ট দেয় না, সাক্ষী চুপ থাকে—সবই তাদের হাতে। একজন ধর্ষিতার জীবনে কেবল ধর্ষণই চূড়ান্ত নয়—তারপর শুরু হয় নতুন করে মানসিক ধর্ষণ। সমাজ প্রশ্ন তোলে—
“ওখানে কী করছিল?”
“ওর চলাফেরা কেমন?”
“ও চুপ কেন ছিল?”
“ও তো ভিডিওতে চুপচাপ ছিল!”
এই সমস্ত প্রশ্ন আসলে ধর্ষকের পক্ষেই যায়। ভুক্তভোগীকে দোষী বানিয়ে সমাজ যেন ধর্ষককে রক্ষা করে। কেউ কেউ এমনও বলে, “বুঝে শুনে চললে কিছুই হতো না।” যেন ধর্ষণের দায় শুধু মেয়েটির।
ধর্ষণের বিচার পেতে গেলে নারীকে যেতে হয় থানায়—সেখানে পুরুষ অফিসারের কাছে বিবরণ দিতে হয় নিজের দেহের চরম অপমানের। তারপর যেতে হয় হাসপাতালে, যেখানে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নামে এখনো অবমাননাকর কিছু পরীক্ষা চলে। এরপর শুরু হয় আদালতের দীর্ঘ নাটক, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, আইনজীবীর ‘চরিত্র হনন’ প্রশ্ন। বিচার শেষ হতে হতে নারীর আত্মবিশ্বাস চুরমার হয়ে যায়। ধর্ষণের মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা বরদাশতযোগ্য নয়।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে সমাজে বার্তা যাবে—ধর্ষণ করলে কেউ রেহাই পাবে না। নারী-পুরুষ সমান, কারও শরীর কারও সম্পত্তি নয়—এই বোধ শিশুদের মধ্যেই গড়ে তুলতে হবে। শুধু বইয়ে নয়, বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করতে হবে। ধর্ষিতার নাম, ছবি, পরিচয় প্রকাশ একেবারে নিষিদ্ধ করা উচিত। ভিকটিম ব্লেমিংকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। নারী মানেই ‘লজ্জা’ নয়, নারী মানেই দুর্বল নয়—এই ধারণা পরিবার থেকে শুরু হওয়া উচিত।
ধর্ষক কেবল মানুষ নয়, একটি মানসিকতা। সে মানসিকতা যদি সমাজ থেকে দূর না করা যায়, তাহলে ফাঁসি দিয়েও লাভ হবে না। নতুন ধর্ষক জন্ম নেবে—নতুন মুখে, নতুন ছদ্মবেশে। আমরা যদি সত্যিই নারীর প্রতি সম্মান দিতে চাই, তবে আমাদের লড়াই শুরু করতে হবে মন থেকে, মুখোশ থেকে নয়। ধর্ষণ শুধু শরীরের না, আত্মার, অস্তিত্বের অপমান৷ আর এই অপমানের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলতেই থাকবে,যতদিন না সমাজ নারীকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক।