আর্কাইভ  সোমবার ● ১১ আগস্ট ২০২৫ ● ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ১১ আগস্ট ২০২৫

পাহাড়পুর: অতীতের আঙিনায় দাঁড়িয়ে ঐতিহ্যের ছোঁয়া

সোমবার, ১১ আগস্ট ২০২৫, দুপুর ১০:১৮

Advertisement

মাসুদ রানা

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহার, যা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার নামেও পরিচিত। শিলালিপি থেকে জানা যায়, এর পূর্ণ নাম ছিল শ্রী সোমপুর-শ্রী-ধর্মপালদেব-মহাবিহার-ভিক্ষু সঙ্ঘ। গবেষকদের মতে, এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বৌদ্ধবিহার। বাংলাদেশে অবস্থিত তিনটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি হলো এই মহাবিহার, অপর দুটি হলো বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং সুন্দরবন।
 
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট
 
প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল বংশ প্রায় চার শতাব্দী শাসন করেছিল। বাংলা ও বিহারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ রাজ্য তার শীর্ষ সময়ে উত্তর-পশ্চিমে পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পাল রাজারা ছিলেন আন্তরিক বৌদ্ধ। ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় সম্রাট ধর্মপালের আমলেই সোমপুর মহাবিহার নির্মিত হয়। তবে তিব্বতীয় ইতিহাসগ্রন্থ পাগ সাম জোন ঝাং-এ উল্লেখ রয়েছে, ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (৮১০–৮৫০) এই বিশাল বিহার ও সুউচ্চ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
 
স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য এই মহাবিহার বহু শতাব্দী মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। দূর থেকে পাহাড়ের মতো দেখাত বলে এ এলাকার নামকরণ হয় “পাহাড়পুর”। সে সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়াও চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে বহু ভিক্ষু ও শিক্ষার্থী এখানে ধর্মচর্চা ও শিক্ষালাভের জন্য আসতেন। খ্রিষ্টীয় দশম শতকে এখানে আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, যার জ্ঞানের খ্যাতি তিব্বত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। প্রচলিত আছে, তিনি তিব্বতে পানির সংকট সমাধান করেছিলেন। তাঁর জন্ম বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে, যা বর্তমান ঢাকার কাছে।
 
পুনঃআবিষ্কার ও খনন
 
প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে হারিয়ে থাকা এই মহাবিহারের অবস্থান প্রথম শনাক্ত হয় ইংরেজ আমলে, ১৮০৭–১৮১২ সালের মধ্যে ভূমি জরিপের সময়। ১৮৭৯ সালে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এবং ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশ ভারতের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আংশিক খনন কাজ সম্পন্ন করে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮০-এর দশকে পূর্ণমাত্রায় খনন শুরু হয় এবং ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়।
 
স্থাপত্যশৈলী ও নকশা
 
প্রায় ২৭ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ মহাবিহারে মোট ১৭৭টি কক্ষ রয়েছে। কেন্দ্রস্থলে বিশাল মন্দিরটি ক্রুশাকার বেইসমেন্টের ওপর নির্মিত, যার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০৮.৩ মিটার এবং প্রস্থ ৯৫.৪৫ মিটার। কেন্দ্রে রয়েছে দরজা-জানালাবিহীন একটি শূন্যগর্ভ চতুষ্কোণ প্রকোষ্ঠ, যা তলা থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমানে মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ২১ মিটার হলেও ধারণা করা হয়, একসময় এটি ৩০ মিটারেরও বেশি ছিল। স্থানীয়দের মতে, মন্দিরটি ধীরে ধীরে বসে যাচ্ছে এবং আশির দশকের খননকালে এর উচ্চতা আরও বেশি ছিল।
 
মন্দিরের দেয়ালে টেরাকোটার অলংকরণে নানান ভাস্কর্যশিল্প ফুটে উঠেছে। চারপাশের কক্ষগুলোতে প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধক ও শিক্ষার্থী ভিক্ষুরা থাকতেন। উত্তর পাশে এক সারিতে ৪৫টি এবং বাকি তিন পাশে ৪৪টি করে কক্ষ রয়েছে।
 
পাল যুগে সোমপুর ছাড়াও বিক্রমশীলা, নালন্দা, ওদান্তপুরী এবং রাজশাহীর জগদ্দলবিহারসহ পাঁচটি প্রধান মহাবিহারের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, যা অনেকটা বর্তমান যুগের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সহযোগিতার মতো।
 
যেভাবে যাবেন
 
ঢাকা:
 
বাস বা ট্রেন → নওগাঁ/জয়পুরহাট → অটোরিকশা → পাহাড়পুর
 
রংপুর:
 
বাস → বগুড়া → নওগাঁ/জয়পুরহাট → অটোরিকশা → পাহাড়পুর
 
চট্টগ্রাম:
 
বাস বা ট্রেন → ঢাকা → নওগাঁ/জয়পুরহাট → অটোরিকশা → পাহাড়পুর
 
খুলনা:
 
বাস → ঢাকা বা বগুড়া → নওগাঁ/জয়পুরহাট → অটোরিকশা → পাহাড়পুর
 
সিলেট:
 
বাস বা ট্রেন → ঢাকা → নওগাঁ/জয়পুরহাট → অটোরিকশা → পাহাড়পুর
 
বরিশাল:
 
বাস → ঢাকা বা খুলনা → নওগাঁ/জয়পুরহাট → অটোরিকশা → পাহাড়পুর
 
ময়মনসিংহ:
 
বাস বা ট্রেন → ঢাকা → নওগাঁ/জয়পুরহাট → অটোরিকশা → পাহাড়পুর
 
 
পতন ও বর্তমান অবস্থা
 
বিহারটির ধ্বংসের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ধারণা করা হয়, বৌদ্ধ শাসনের পতন, হিন্দুপ্রধান সেন বংশের উত্থান এবং পরবর্তীতে মুসলিম বিজয়ের ফলে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং অবশেষে পরিত্যক্ত হয়—প্রায় ৮০০ বছর আগে।
 
বর্তমানে এটি প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার এক অমূল্য নিদর্শন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিহারটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। সোমবার আধাবেলা এবং রোববার সারাদিন বন্ধ থাকে। প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। শেষ বিকেলে এর লালচে ইটের আভা যেন স্মরণ করিয়ে দেয় মাটি চাপা পড়ে যাওয়া এক সভ্যতার গল্প এবং মানুষের ক্ষণস্থায়িত্ব।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন


Link copied