নিউজ ডেস্ক: শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীণ ঋণ কেলেঙ্কারি, লুটপাট ও টাকা পাচারের ঘটনা ঘটেছে। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে এর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকগুলো সম্মুখীন হয়েছে তীব্র চাপের। তারল্য সংকটে পড়েছে অনেক ব্যাংক। চাহিদা অনুযায়ী আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না এবং ঋণ পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।
জালিয়াতি ও উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা কমায় ঋণ আদায় কমেছে। রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি। সুদ থেকে ব্যাংকগুলোর নিট আয় কমেছে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী মূলধনের জোগান দিতে না পারায় ঘাটতি বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়েছে। মোট সম্পদ কমেছে। সবমিলিয়ে ব্যাংক খাতে মূলধন সংরক্ষণের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। যা ব্যাংক খাতের পদ্ধতিগত ‘ভঙ্গুরতা’কে স্পষ্ট করে তুলেছে- এমন মন্তব্য করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২৪’-এ।
সোমবার রাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। সেখানে দেশের সার্বিক অর্থনীতি, ব্যাংক খাত, ফাইন্যান্স কোম্পানিসহ অন্যান্য আর্থিক খাতের ঝুঁকির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২০২৪ সালের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। ওই সময়ের তথ্যের আলোকে নানা খাতের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্তব্য করেছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটপাটের চিত্র ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রকাশিত হয়েছে; যা অব্যাহত আছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ২০২৪ সালের তুলনায় পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং কোনো কোনো খাতে অবনতি ঘটেছে। লুটপাটের ঋণ এখন খেলাপি হওয়ায় খেলাপি ঋণ পাগলা ঘোড়ার গতিতে বাড়ছে। কিন্তু এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আয় বাড়ছে না। কারণ জালিয়াতির ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। সেগুলোর বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। এগুলো এখন খেলাপি হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর আয় কমেছে। বেড়েছে ব্যয়। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপও নিতে পারছে না।
তবে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারের একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনটি টাস্কফোর্স কাজ করছে। তাদের নেওয়া নানা পদক্ষেপের ফলে সুশাসন ফিরতে শুরু করেছে। তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেড়েছে। টাকা পাচার ও লুটপাট বন্ধ হওয়ায় ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। তবে তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে ব্যাংকিং খাত তীব্র চাপের সম্মুখীন হয়েছিল। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন সংরক্ষণের দিক থেকে এই চাপ তৈরি হয়েছিল। এতে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে মূলধন পর্যাপ্ততার ক্ষেত্রে বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন রাখার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পৌঁছে। খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি, খরচ বাড়া ও আয় কমায় ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের হার স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন পৌঁছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে মূলধন সংরক্ষণের হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ব্যাংকগুলোকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। ঝুঁকিমুক্ত থাকতে কমপক্ষে ১২ শতাংশ মূলধন রাখতে হয়। সেখানে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মূলধন রয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। যা ন্যূনতম প্রয়োজনের তুলনায় ৬ দশমিক ৯২ শতাংশই কম।
ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়লে, আয় কমে গেলে, প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেলে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ কমে যায়। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে আগামীতে আয় কমার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। ব্যাংকের সম্পদ কমতে থাকে। সম্পদের মানও কমে যেতে থাকে। তখন মূলধন ঘাটতি বেড়ে যেতে থাকে। এমন অবস্থা সৃষ্টি হলেই ভঙ্গুরতা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। দেশের ব্যাংক খাতে এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে এখনকার সূচকগুলোকে বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদ্ধতিগত ভঙ্গুরতার সঙ্গে তুলনা করেছে ব্যাংক খাতকে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক এবং ইসলামিক ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দুর্বল মূলধনের কারণে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে গেছে। এ কারণে বেড়েছে ঝুঁকির মাত্রাও। বাংলাদেশে ২০২০ সালে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের হার ছিল ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ, করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ২০২১ সালে তা সামান্য কমে মূলধন সংরক্ষণের হার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২২ সালে করোনার ধাক্কা কিছুটা কাটিয়ে ওঠলে ব্যাংকগুলোর মূলধন রাখার হার কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশে। বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কায় এ হার আবার কিছুটা কমে ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ওই সময়ে ব্যাংক খাতের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হতো না বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের প্রকৃত তথ্য বের হয়ে আসতে থাকে। আগে যা গোপন করা হয়েছিল। এতে খেলাপি ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। সঙ্গে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতিও বাড়তে থাকে। আয় কমতে থাকে। বাড়তে থাকে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর মূলধন রাখার হার বেড়ে যায়। কিন্তু অর্থ সংকটে ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী মূলধন রাখতে পারেনি। ফলে এ হার কমে স্মরণকালের সর্বনিম্ন অবস্থান করে অর্থাৎ ৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। এ হার চাহিদার তুলনায় যেমন অনেক কম, তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায়ও বেশ কম।
২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক চাপের মধ্যেও ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার মূলধন রাখার হার বেড়েছে। শ্রীলংকা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হলেও, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে ওঠলেও তাদের মূলধন রাখার হার ১৭ শতাংশ থেকে কমে ১৬ শতাংশে নেমেছিল। ২০২৩ সালেই দেশটি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন রাখতে হয়, সেখানে বর্তমানে শ্রীলংকার মূলধন রয়েছে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে থেকেও পাকিস্তানের ব্যাংক খাতে মূলধন সংরক্ষণের হার ২০ দশমিক ৬০ শতাংশ। ভারতে এ হার ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ।
গত সরকারের আমলে সরকারি খাতের দুটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকগুলো বিশেষভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশে নেমে এসেছে। খেলাপি ঋণ ২৩ দশমিক ১৮ শতাংশে ওঠেছে। এখন এটি আরও বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে চড়া সুদে আমানত নিয়েছে। ফলে এদের তহবিল ব্যয় বেড়েছে। এতে আয় কমেছে। ফলে সম্পদ বা ঋণ বা বিনিয়োগ থেকে আয় কমে গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে ব্যাংকগুলোর ঋণ ঝুঁকির মাত্রাও বেড়েছে। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা জামানতের মান হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকগুলোর করপোরেট খাতেই বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। এ খাতে বিতরণ করা ঋণের ৬৮ দশমিক ২২ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়েছে। যা ব্যাংকগুলোর জন্য ঝুঁকির মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংক খাতে কি ধরনের ধাক্কা আসতে পারে- তার একটি সমীক্ষা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, সূচকগুলো ব্যাংক খাতের দুর্বলতাকে আরও প্রকটভাবে প্রকাশ করেছে। ব্যাংকগুলোর মূলধনের ধাক্কা ইতোমধ্যেই লেগে গেছে। ঋণের গুণগত মান হ্রাসের কারণে একদিকে যেমন খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তেমনি প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গিয়ে মূলধন রাখার হার আরও কমে যেতে পারে। কেননা ডিসেম্বরের তুলনায় ইতোমধ্যে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর আয় বাড়েনি। ফলে প্রভিশন ঘাটতি আরও বেড়ে গিয়ে মূলধনের হার আরও কমিয়ে দেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বেশি মাত্রায় বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। শীর্ষ দুটি বড় অঙ্কের ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে মূলধন পর্যাপ্ততার জন্য সবচেয়ে গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করবে। তারপরে জামানতের মান কমে গেলে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।