নিউজ ডেস্ক: মে দিবস এলেই আলোচনায় আসে পোশাকশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক কিংবা পরিবহন খাতের মানুষদের কথা। অথচ লাইট, ক্যামেরা আর তারকার ঝলকে ঘেরা বিনোদনজগতে যাঁরা দিনরাত ঘাম ঝরিয়ে নাটক, সিনেমা কিংবা বিজ্ঞাপন তৈরি করেন, সেই প্রোডাকশন ইউনিটের কলাকুশলীদের কথা তেমন আলোচনা হয় না। নেপথ্যে থাকা সহকারী পরিচালক, সেট নির্মাতা, লাইটম্যান, প্রোডাকশন, মেকআপ আর্টিস্টদের কথা অনেকটাই উপেক্ষিত।
‘আমাদের নাম থাকে না, কিন্তু কাজটা থাকে’
পুবাইলে আসন্ন ঈদের সিরিয়ালের শুটিংয়ে ব্যস্ত প্রোডাকশন ম্যানেজার আব্বাস। ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন ২৩ বছর ধরে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা শুটিংয়ে ভোরে আসি, সবার আগে আর সব গুছিয়ে যাই সবার পরে। কিন্তু যখন কোনো কাজ প্রচার হয়, তখন কেউ জানেও না আমি ছিলাম। আমাদের নাম আসে সবার শেষে, কেউ পড়েও না। তবে নামের জন্য তো কাজ করি না, নাম না থাকলেও, কাজটা থাকে।’
শ্রম আছে, সুরক্ষা নেই
এখানে নেই বেতনকাঠামো, নেই স্থায়ী কোনো নিয়োগপত্র। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে বা কাজ হারালে আইনগতভাবে কিছু দাবি করাও কঠিন। শুটিংয়ে আহত হলে চিকিৎসার ভার বহন করতে হয় নিজের। আব্বাসের কথায়, ‘মনে করেন আজ কাজ করছি, আল্লাহ না করুক, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমার পরিবারকে তা বহন করতে হবে। আমরা তো দিনমজুর, এর বাইরে আমাদের কোনো কিছু চাওয়ার সুযোগ নেই। অনেক ইউনিটে আমাদের টাকা বাকি থাকলেও আমরা সমিতিগুলোতে অভিযোগ দিতে পারি, কিন্তু আইনগতভাবে কিছুই করার থাকে না আমাদের। কারণ, আমাদের তো স্থায়ী কোনো নিয়োগপত্র নেই।’
‘ঈদের রাতে একা মেসে চুপি চুপি কেঁদেছি’
সহকারী পরিচালক হিসেবে সাত বছর ধরে কাজ করছেন রাজ। এত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে থাকলেও এখনো পারিশ্রমিকের নিশ্চয়তা পাননি তিনি। রাজ বলেন, ‘গত ঈদের কথাই বলি, ছয়টার মতো প্রোডাকশন করেছি। রমজানে এমনও হয়েছে, সবাই ইফতার করছে আর আমি মুখে একটা খেজুর দিয়ে কিছু কিনতে নিউমার্কেট যাচ্ছি বা পরের দৃশ্যের জন্য সেট গুছাচ্ছি। এরপর চাঁদরাত পর্যন্ত এডিটিংয়ে থাকতে হয়েছে আমার। চ্যানেল বা প্ল্যাটফর্মে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যখন টাকা চেয়েছি, বেশির ভাগ জায়গা থেকে উত্তর পেয়েছি, প্রচারের পর টাকা দেওয়া হবে। টাকা না পাওয়াতে বাড়ি যাওয়া হয়নি। খালি পকেট আর পুরোনো জামায় ঈদ করতে হয়েছে, মেসের একা ঘরে কান্না করেছি। এই চিত্র শুধু আমাকেই দেখতে হয়েছে তা কিন্তু নয়, ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটি সহকারী পরিচালককে একবার হলেও তা ফেস করতে হয়েছে, হচ্ছে।’ তবে এখানে ব্যতিক্রমও আছেন বলে মনে করেন রাজ। তিনি বলেন, ‘এখানে অনেকেই যেমন ঠকিয়েছেন, আবার অনেক বড় ভাইও পেয়েছি। শুধু পারিশ্রমিক নয়, পারিবারিক বিভিন্ন সংকটেও তাদের সহযোগিতা পেয়েছি।’
তারকারা কী ভাবেন
হতাশার মাঝে ভালো দৃষ্টান্তও আছে। অনেক তারকা নিজ উদ্যোগে ইউনিটের টেকনিশিয়ানদের সম্মাননা দেন, ইফতার আয়োজন, ঈদ-পার্বণে বোনাস, এমনকি ব্যক্তিগতভাবে সাহায্যও করেন। তাঁদের নিয়ে তারকাদের ভাবনা কী? জানতে চাওয়া হয় পর্দার ব্যস্ততম দুই অভিনয়শিল্পী আরশ খান ও আইশা খানের কাছে। তাঁরা মনে করেন পুরো ইউনিট নিয়েই এক পরিবার, পরিবারের কাউকে খারাপ রাখলে একে সুখী পরিবার বলা যায় না।
আরশ খান মনে করেন, ক্যামেরার পেছনের এ মানুষগুলো না থাকলে নিজেদের তারকাখ্যাতির কোনো মূল্য নেই। আরশ বলেন, ‘ওনারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন শুটিংয়ে যাই, আমাদের কেন্দ্র বানিয়ে তাঁরা কাজ করেন। আমাদের যে সম্মান তাঁরা করেন, মনে করি তাঁদেরও এ সম্মান প্রাপ্য। দেখুন পরিবার বা ভক্তদের সঙ্গে আমরা কতক্ষণ থাকি? দিনের পুরোটা সময় কিন্তু ইউনিটের সঙ্গেই আমাদের থাকা হয়। আমি একজন তারকা বা আমাকে কিছু মানুষ চেনে, ওই বিষয়টা কিন্তু তাঁদের যত্নেই আমি বুঝি, তাঁরাই কিন্তু আমাকে স্পেশাল ফিল করান। এমনও হয়, একজনের মাথায় হয়তো ৩০ কেজি ওজনের কিছু, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে সে যখন আমাকে নামতে দেখে, সে জায়গা দিয়ে দেয়। নিজেকে তখন অনেক ভাগ্যবান মনে হয়।
নেপথ্যের প্রতিটা মানুষ ভালো থাকুক।’
সময়ের আরেক ব্যস্ত অভিনেত্রী আইশা খান। তিনি মনে করেন ইউনিটের সবাই তাঁর জন্য আশীর্বাদ। পর্দায় দর্শকেরা তাঁকে যতটা সুন্দর দেখেন, তাঁর অভিনয়ের যতটা প্রশংসা করেন, এর পুরো কৃতিত্ব প্রোডাকশন ইউনিটের।
আইশার কথায়, ‘সেটে যখন আসি, লাগেজ থেকে শুরু করে প্রতিটা জিনিস যত্নের সঙ্গে বহন করেন প্রোডাকশন বয়রা। পুরো সময় খেয়াল রাখেন, কখন পানি লাগবে, চা লাগবে, কিছু খেতে চাচ্ছি কি না—এভরিথিং। প্রতিটা চরিত্রে মানিয়ে নিতে মেকআপ টিম পরিশ্রম করে। নিজের ভেতর যে একটা আত্মবিশ্বাস জন্মায়, এটা কিন্তু তাঁদের কারণেই। যদি লাইটের কথা বলি, দর্শকদের কাছে তাঁরাই কিন্তু আমাদের ফুটিয়ে তোলেন। এ ছাড়া সহকারী পরিচালকেরা প্রতিটা সিকোয়েন্স বুঝিয়ে দেওয়া, কোন সিকোয়েন্সের পর কী করতে চাচ্ছেন নির্মাতা, সেটে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, প্রতিটা জিনিসে যত্ন নেন। এসব মানুষের জন্যই আমরা নির্ভার থাকি।’
তবে এখানে ব্যতিক্রমও আছে। অনেক তারকার খারাপ আচরণের সাক্ষীও হতে হয় তাঁদের। শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রী নয়, নির্মাতা থেকে প্রযোজকদের কাছেও খারাপ আচরণের শিকার হন তাঁরা। যেমন গত বছর পাওনা টাকা চাওয়ায় নির্মাতা রুবেল আনুশের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ এনেছিলেন প্রোডাকশন ম্যানেজার দ্বীন ইসলাম দিনার। এ নিয়ে কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুমকিও দেন প্রোডাকশন ম্যানেজাররা।
সংগঠনগুলো কী করছে?
নাটক ও চলচ্চিত্রের সংগঠনগুলো সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু সহযোগিতা করলেও, এখনো নেই কোনো সর্বজনীন কর্মনীতি বা স্বাস্থ্যবিমা কাঠামো। মে দিবস এলেও জীবনে বাস্তব পরিবর্তনের প্রতিফলন নেই। টেলিভিশন মিডিয়া প্রোডাকশন ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংগঠনের দায়িত্বে যেহেতু আছি, সব সময় চেষ্টা করি কে কোন ইউনিটে কাজ করছে, মজুরি ঠিকমতো পাচ্ছে কি না সবকিছুর খেয়াল রাখতে। ইউনিটে অনেক জায়গায় খারাপ আচরণ তো আছেই, নিয়মিত পাওনা টাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ নিয়ে দফায় দফায় সংশ্লিষ্ট সংগঠনের সঙ্গে আমরা বসছি, কিন্তু এরপরও এমন হচ্ছেই। নিজেদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
ছোট পর্দার সহকারী পরিচালকদের সংগঠন টেলিভিশন এ্যসিসটেন্ট ডিরেক্টর'স অর্গানাইজেশন অব বাংলাদেশ। বর্তমান চিত্র তুলে ধরে সংগঠনটির সভাপতি জীবন রায় বলেন, ‘অনেক যন্ত্রণা পোহাতে হয় আমাদের। যেকোনো কাজের মাসখানেক আগে থেকেই কিন্তু পরিচালকের সঙ্গে সহকারী পরিচালকেরা যুক্ত হোন, কিন্তু দেখা যায় কাজ প্রচার হলেও টাকা পাওয়া যায় না। টাকা চাইলে, পরের কাজে ডাকা হয় না। আমার মনে হয় আমরাই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হই। আগে–পরে সবাই টাকা পেয়ে যান, সহকারী পরিচালকেরাই এখানে বাকির তালিকায় যুক্ত হোন।’ এ সংকট সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। কিন্তু মিটিংয়ের পর মিটিং হলেও তা আলোরে মুখ দেখছে না। জীবন রায়ের কথায়, ‘চুক্তিপত্রের দাবি থেকে কর্মঘণ্টা নির্ধারণের দাবি করে আসছি অনেক দিন ধরে। অনেক সভা–সেমিনার হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। দেখুন সবাই তো আর ডিরেক্টর হতে পারেন না, তাই অনেকেই হতাশা থেকে অনিশ্চিত এ পেশা পরিবর্তন করছেন। যাঁরা টিকে আছেন, তাঁরাও আছেন ঘোর সংকটে।’
কনফেডারেশনের উদ্যোগ
চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও ডিজিটাল মাধ্যমে কর্মরত পেশাদারদের যৌথ প্ল্যাটফর্ম ‘কনফেডারেশন’ মে দিবস উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। সেখানে ২০টি সংগঠনের প্রতিনিধিদের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। সভায় উপস্থাপন করা হবে ১১ দফা প্রস্তাব—যার মধ্যে রয়েছে: শুটিং শুরুর আগেই লিখিত চুক্তিপত্র স্বাক্ষর, একটানা ১২ ঘণ্টার কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, শুটিংয়ের দিন অন-স্পট পারিশ্রমিক প্রদান, পরিবহন ও খাবারের সুব্যবস্থা, দুর্ঘটনায় চিকিৎসা খরচ বহনের প্রতিশ্রুতি এবং নির্ধারিত পারিশ্রমিক না দেওয়া পর্যন্ত ক্রু পরিবর্তন না করার বিধান। এসব দাবির লক্ষ্য, কলাকুশলীদের একটি ন্যূনতম সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
কনফেডারেশনের মহাসচিব আবু জাফর অপু বললেন, ‘আমরা বহু বছর ধরেই এসব দাবি করে আসছি। এ দাবিগুলো নতুন কিছু নয়, বরং বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা। আজকের আলোচনায় যদি এসব দাবি বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হয়, সেটাই হবে আমাদের শ্রমিক দিবসের প্রকৃত প্রাপ্তি।’ কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—আলোচনার টেবিল থেকে কবে বাস্তবায়নের মঞ্চে পৌঁছাবে এসব প্রতিশ্রুতি? কারণ, নেপথ্যের মানুষদের জীবনে আজও মে দিবস মানে শুধু আরেকটা কর্মব্যস্ত দিন।