নিউজ ডেস্ক: রংপুর নগরবাসী যেন মশার হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ড্রেন, খাল, জলাবদ্ধতা আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতিতে মশার বংশবিস্তার বেড়েছে ভয়াবহ হারে। সিটি করপোরেশন প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা মশক নিধনে ব্যয় করলেও বাস্তবে তার কার্যকারিতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর।
সরেজমিনে রংপুর নগরীর কেড়ানি পাড়া, সেনপাড়া, গোমস্তাপাড়া, তাজহাট, বাবুখাঁর মোড়, রাধাবল্লভসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিনের বেলাতেও মানুষ মশারি টাঙিয়ে ঘরে বসে আছে। দরজা-জানালা বন্ধ রেখেও মিলছে না স্বস্তি। বাসিন্দারা বলছেন, মশার আক্রমণ এতটাই ভয়াবহ যে ঘরের ভেতর কয়েল, স্প্রে, ইলেকট্রিক ব্যাট ব্যবহার করেও রেহাই মিলছে না।
কেড়ানি পাড়ার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, শ্যামা সুন্দরী খাল এখন আমাদের গলার কাঁটা। এত ময়লা জমেছে, এখন এটা মশা মাছির উৎপাদন কারখানা হয়ে গেছে। ডেঙ্গুর মৌসুম চলছে, অথচ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই।
তাজহাটের বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। কয়েল জ্বালাই, স্প্রে দিই, কিন্তু কিছুতেই মশা কমে না। মনে হয় আমরা এখন মশার দুনিয়ায় বাস করছি।
সেন পাড়ার গৃহবধূ জাহেদা খাতুন বলেন, আসরের নামাজের পর থেকে এত মশা উঠে যে মশারির বাইরে থাকা যায় না। কয়েল জ্বালিয়েও লাভ হচ্ছে না।
গোমস্তা পাড়ার বাসিন্দা রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কখনো দেখি নাই সিটি করপোরেশন শ্যামা সুন্দরী খালের সংস্কার বা পরিষ্কারে কোনো কাজ করছে। খালটা এখন পুরোপুরি মশার রাজ্যে পরিণত হয়েছে।’
রংপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম জানান, মশার জন্য ঠিকমতো পড়াশোনা বা খেলাধুলা কিছুই করা যাচ্ছে না। একটু খেললেই গায়ে ফোলা পড়ে, পরে জ্বর আসে।
রংপুর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশক নিধনে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে আরও বেশি, প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অথচ, শহরে মশার উপদ্রব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ফাতিমা বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে ফগার মেশিন ও স্প্রে ছিটানো হচ্ছে। তবে জনবল ও ওষুধ স্বল্পতার কারণে কাজ কিছুটা ধীরগতিতে চলছে। মশার প্রজনন কেন্দ্রগুলো চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তবে নগরবাসীর দাবি, কাগজে-কলমে এসব পদক্ষেপ থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন মিলছে না।
রংপুর মডার্ন এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হাসান বলেন, ‘ফগার মেশিনের কথা তো কাগজে আছে, বাস্তবে কোনো দিন দেখি নাই আমাদের এলাকায় ছিটাতে আসছে। শুধু বর্ষা এলেই লোক দেখানো কিছু করে, তারপর আর খোঁজ নেই।’ জুম্মাপাড়া এলাকার আবদুল লতিফ বলেন, পত্রিকায় দেখি কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, কিন্তু আমরা তো সেই টাকার কোনো কাজ চোখে দেখি না। সব শুধু কাগজে, মাঠে তো মশার রাজত্ব।
লালবাগ এলাকার কলেজছাত্রী ফারহানা হক বলেন, আমি চার বছর ধরে এখানেই থাকি। এখনো দেখিনি কারও বাড়ির আশপাশে স্প্রে করতে আসছে। অথচ প্রতিবছর বাজেট বাড়ে, কাজ কিন্তু একই রকম ফাঁকা।
রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ জন। যদিও সংখ্যা তুলনামূলক কম, তবে প্রতিদিন বাড়ছে জ্বর ও চুলকানিসহ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশক নিধনে কেবল স্প্রে বা ফগার যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি প্রয়োজন ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাল পরিষ্কার, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিয়মিত মনিটরিং। ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথমেই অ্যানোফিলিস ও এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। শুধু ওষুধ ছিটিয়ে লাভ নেই, এর সঙ্গে পরিবেশ ব্যবস্থাপনাও জরুরি।