নিউজ ডেস্ক: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- এ নিয়ে কোনো সংশয় দেখছে না বিএনপি। তবে নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে দেশি-বিদেশি নানা শক্তির ষড়যন্ত্র চালু আছে মনে করে দলটি। এ অবস্থায় ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার পাশাপাশি জুলাই সনদেও স্বাক্ষর করবে দলটি।
তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তরফ থেকে পাঠানো জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়েছে দলটির চোখে। এ নিয়ে গত সোমবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে ২৮ পৃষ্ঠার এই খসড়া পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করতে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদসহ তিন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত
নেতারা কাজও শুরু করেছেন। গতকাল সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই হবে। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। কমিশনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাও খুব দৃঢ়ভাবে এ নিয়ে কথাও বলেছেন। এটা নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই।
এদিকে আজ বুধবার বিকাল ৪টার মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়ার বিষয়ে দলীয় মতামত জমা দেওয়ার সময়সীমা নির্ধারিত রয়েছে।
বিএনপির বৈঠক সূত্র জানায়, জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া নিয়ে বিএনপির আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রথমে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। এরপর বিএনপির শীর্ষ নেতারাও বৈঠক করেন। তবে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনে ইতিপূর্বে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে দুই-একটি মৌলিক প্রস্তাবে বিএনপি শব্দগত কিছু পরিবর্তন আনতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানায়, দলটি মনে করে সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ডকুমেন্ট বা নথির অবস্থান সংবিধানের ওপরে হতে পারে না। অর্থাৎ জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে জায়গা দেওয়ার সুযোগ নেই। যদি এমনটা করা হয়, তাহলে সেটা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হবে। এ ছাড়া জুলাই সনদ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে অঙ্গীকারনামায় যে কথা বলা হয়েছে, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনো ডকুমেন্ট সংবিধানের ওপরে হতে পারে না। আমরা সংবিধানের মধ্যে আইনি বৈধতা এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় কীভাবে এই সমঝোতা দলিলটাকে বাস্তবায়ন করতে পারি, সেই চিন্তা করতে হবে। এখন যদি বলা হয় এই দলিলের সব কিছু সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য পাবে, তাহলে এটা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির সৃষ্টি হবে- এটা করা ঠিক হবে না।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না- এই এখতিয়ার কি আমাদের সংবিধান কাউকে দিয়েছে? আমার মনে হয় এটা সঠিকভাবে উচ্চারিত হয়নি। এটা অন্য কোনোভাবে হয়তো লেখা যেত। আদালতের প্রশ্ন তুলতেই পারে কেউ। আর্টিক্যাল ৩১ অনুসারে আইনের আশ্রয় নেওয়া যে কোনো নাগরিকের অধিকার। আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, এ বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা ঠিক হবে না।’
তবে সূত্রমতে, জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে সামগ্রিকভাবে খুব বেশি আপত্তি নেই বিএনপির। সনদে উত্থাপিত ৮৪ দফার মধ্যে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং যেসব বিষয়ে দলগুলো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেগুলোর সমাধানের পথ কী হবে, তা নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে দলীয় মতামত তুলে ধরবে।
বৈঠকে দলটির নেতারা বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের প্রথম খসড়ায় সংবিধান সংশোধন ও যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো আগামী সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল। তবে পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়ায় সেই অঙ্গীকার আর নেই।
বিএনপি যেসব মৌলিক প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেগুলোতে ছাড় দিতে চায় না দলটি। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, এখানে বিএনপি তাদের আগের অবস্থানেই থাকতে চায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একইসঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না, নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ সদস্য নির্বাচিত হবেন।
বিএনপি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছু ভারসাম্য আনতে রাজি। তবে এমন ভারসাম্য চায় না, যেখানে সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে না। দলটি মনে করে, সার্বিক বিবেচনায় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করা হলে সংসদীয় গণতন্ত্র তেমন অর্থবহ থাকবে না। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকলে, সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে।
জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলো কোনো কোনো প্রস্তাবে একমত হয়েছে এবং কোনো প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেটা উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনায় ১৯টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে বিএনপি ১২টিতে একমত এবং ৭টিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে।
জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ার সূচনা এবং ২, ৩ ও ৪ দফা নিয়ে বিএনপির আপত্তির কথা জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। খসড়া সনদের সূচনায় অসত্য তথ্য দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। খসড়ার সমালোচনা করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কিছু কিছু বিষয় আলোচনা করা না হলেও তা সেখানে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি।
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘জুলাই সনদে উত্থাপিত ৮৪ দফার মধ্যে যেসব দফায় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে; যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট এসেছে, সেগুলোর সুরাহা কীভাবে হবে এবং সংবিধান সংস্কারবিষয়ক যেসব কথা এসেছে, তার বান্তবায়ন কীভাবে হবে-এসবের নিষ্পত্তি জরুরি। এসব কিছু পর্যালোচনা করে কমিশনকে মতামত জানাবে বিএনপি।’
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘বলা হয়েছে- এই সনদের বিধিবিধানের ব্যাখ্যা চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আপিল বিভাগের ওপর কী এমন কোনো আইন ন্যস্ত করতে পারি? কোনো মামলার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ডিভিশন থেকে আপিল বিভাগে আপিল হয়। তা ছাড়া সংবিধানিক কিছু বিষয়ে আর্টিক্যালের ১০৩ অনুসারে আপিল বিভাগে যাবে। জুলাই সনদ তো সেলফ অডিয়েন্সও নয়, আইনও নয় এবং রায়ও নয়। এখানে ব্যাখ্যার জন্য আপিল বিভাগে কে পাঠাবে? কীসের ভিত্তিতে যাবে? সেই প্রশ্নগুলো আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটা সমঝোতার দলিলের স্বাক্ষর করলাম, সেখানে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আপিল বিভাগের কোনো এখতিয়ার আছে কিনা, এ এখতিয়ারটা কী? এটা খুঁজে বের করতে হবে।’