নিউজ ডেস্ক: ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এখন আর শুধু একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন নয়; এটি হয়ে উঠেছে দেশের চলচ্চিত্রচর্চার এক নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড এবং আন্তর্জাতিক সিনেমা-বিনিময়ের এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম। রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত এই উৎসব এখন বিশ্বের নানা দেশের উৎসব ক্যালেন্ডারে যথেষ্ট সম্মানজনক অবস্থান ধরে রেখেছে।
আগামী জানুয়ারিতে শুরু হতে যাওয়া ২৪তম আসরকে ঘিরে প্রস্তুতি চলছে কয়েক মাস ধরে। সিনেমা বাছাই, শিডিউল তৈরি, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ, অতিথিদের আমন্ত্রণ-সব মিলিয়ে রীতিমতো ব্যস্ত সময় পার করছেন আয়োজকরা।
এবারের প্রতিপাদ্যও বরাবরের মতো ‘নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ’। উৎসব শুরু হবে ১০ জানুয়ারি, চলবে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। ৯ দিনের এই আয়োজনে অংশ নেবে ৯১টি দেশের ২৬৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এর মধ্যে বাংলাদেশের সিনেমার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, ৬৭টি।
উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও আমরা সিনেমা নির্বাচনে গুরুত্ব দিয়েছি নতুন প্রবণতা, নতুন ভাষা এবং সমকালীন ভাবনার প্রতিফলনে। দেশের সিনেমাও এবার শক্ত অবস্থানে আছে।
মূল প্রতিযোগিতা বিভাগ: বাংলাদেশ প্যানোরমায় আট সিনেমা জায়গা করে নিয়েছে। সিনেমাগুলো হলো- হাবিবুল ইসলাম হাবিবের ‘যাপিত জীবন’, সোহেল রানা বয়াতীর ‘নয়া মানুষ’, জ্যাক মিরের ‘দ্য স্টোরি অব আ রক’, জোবাইদুর রহমানের ‘উড়াল’, বিপ্লব কুমার পাল বিপুর ‘ধামের গান’, অনন্য প্রতীক চৌধুরীর ‘নয়া নোট’, সুমন ধরের ‘আগন্তুক’, আহমেদ হাসান সানির ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’। এই বিভাগটি বরাবরের মতোই দেশের চলচ্চিত্রের সার্বিক অগ্রগতি, নির্মাতাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং গল্প বলার বিবিধ রূপ তুলে ধরে। দর্শকের মধ্যেও ‘বাংলাদেশ প্যানোরমা’ নিয়ে থাকে আলাদা আগ্রহ। এখান থেকেই দেখা যায় দেশীয় চলচ্চিত্রের সামগ্রিক চিত্র।
বরাবরের মতো এবারের উৎসবেও থাকছে ১০টি বিভাগ। এগুলো হলো– এশিয়ান প্রতিযোগিতা, রেট্রোস্পেকটিভ, বাংলাদেশ প্যানোরামা, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড, চিলড্রেনস ফিল্ম, স্পিরিচুয়াল ফিল্মস, শর্ট অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম, উইমেন্স ফিল্ম সেশন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা। প্রতিটি বিভাগই আলাদা দর্শক, আলাদা শিল্পভাষার প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষ করে রেট্রোস্পেক্টিভ সেকশন নিয়ে থাকে কৌতূহল, কারণ এখানে সাধারণত কোনো বিশিষ্ট নির্মাতার উল্লেখযোগ্য কর্ম প্রদর্শিত হয়।
ঢাকা শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তন ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ- এই তিন ভেন্যুতে টানা ৯ দিন চলবে সিনেমার প্রদর্শনী। প্রতিদিন শত শত দর্শকের সমাগমে জমে ওঠে মিলনায়তনগুলো। তরুণ নির্মাতাদের কাজ দেখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এ সুযোগকে বছরের বড় সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবেই দেখে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা।
২৪তম আসরকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করবে ‘চাইনিজ ফিল্ম উইক’, যা চীনা চলচ্চিত্রের ১২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজন করা হচ্ছে। স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য মিলিয়ে চীনের ১৫টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। চীনা চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা, কাহিনির গভীরতা, সামাজিক বাস্তবতা- সবকিছুই দর্শকের কাছে তুলে ধরবে এই আয়োজন।
চলচ্চিত্রপ্রেমী, গবেষক ও তরুণ নির্মাতাদের জন্য দারুণ সুযোগ তৈরি করবে মাস্টারক্লাস সেশন। বিভিন্ন দেশের তিনজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নির্মাতা আসবেন তাদের অভিজ্ঞতা ও চলচ্চিত্রভাষার দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে। উৎসব শুরুর আগে ঘোষণা করা হবে তাদের নাম। আগের আসরগুলোতে এসব মাস্টারক্লাসে দারুণ সাড়া পাওয়া গেছে। এবারও তেমনই প্রত্যাশা আয়োজকদের।
১৯৯২ সাল থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে আসছে রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ। দীর্ঘ তিন দশকের এই যাত্রায় তারা শুধু উৎসব আয়োজনই করেনি; চলচ্চিত্র-সংস্কৃতি বিস্তারে প্রকাশ করেছে চলচ্চিত্রবিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘সেলুলয়েড’, আয়োজন করেছে সেমিনার, রেট্রোস্পেক্টিভ, বিশেষ প্রদর্শনী ও শুদ্ধসংগীত আসর।
দেশের চলচ্চিত্র-সচেতন দর্শক তৈরি করতে এই সংগঠনের অবদান অনস্বীকার্য। সব মিলিয়ে নতুন বছরের শুরুতেই রাজধানীজুড়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য অপেক্ষা করছে এক বর্ণিল উৎসব। শুধু সিনেমা দেখাই নয়- চলচ্চিত্রচর্চা, আলোচনার পরিসর ও নতুন ভাবনার আদান-প্রদান-সব মিলিয়ে ঢাকার চলচ্চিত্রপ্রেমীরা পেতে যাচ্ছে এক পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা।