আর্কাইভ  শুক্রবার ● ৬ জুন ২০২৫ ● ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ৬ জুন ২০২৫

পর্দার আড়ালে জাতীয় সরকারের নীলনকশা?

বুধবার, ৪ জুন ২০২৫, দুপুর ১১:৩১

Advertisement

নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন প্রধান প্রশ্ন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে? এই ইস্যুতে এখন পর্যন্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সুস্পষ্ট কোনো অবস্থান নেই। নির্বাচনের পরিবর্তে দেশে চলছে সংস্কার সংস্কার খেলা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এক মাস ধরে বৈঠক করে বলল, ‘এখন দ্বিতীয় রাউন্ড বৈঠক হবে।’ বৈঠকের নামে এই তামাশার মানে যে কালক্ষেপণ, তা বুঝতে কারো অসুবিধা নেই।

’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। তার আগেও প্রয়োজনে নির্বাচন করা সম্ভব।’ কিন্তু বিএনপি যা-ই বলুক না কেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পথে যাওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার; তার কোনো কিছুই সরকারের পক্ষ থেকে শুরু হয়নি। যখন দেশের ভবিষ্যৎ হচ্ছে নির্বাচন; অন্যদিকে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রয়েছে নানা রকম অনিশ্চয়তা; ঠিক তখন পর্দার আড়ালে জাতীয় সরকার গঠনের নানা রকম আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছে।

সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছে সুধীসমাজের একটি অংশ। এ নিয়ে রাজনীতিতে চাপা আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে আগ্রহী নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম জাতীয় সরকার প্রসঙ্গটি এসেছিল।

সেই সময় বিভিন্ন মহল থেকে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য একটা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি সেই সময় সরাসরি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের অন্তত দুজন সদস্য তাঁদের প্রকাশিত নতুন বইয়েও জাতীয় সরকারের উদ্যোগের কথা লিখেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের জাতীয় সরকারে যেতে তারা ইচ্ছুক নয়, বরং একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়া উচিত। যে সরকারের তত্ত্বাবধানে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির এই অবস্থান ছিল দূরদর্শী এবং রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব একটি সিদ্ধান্ত। বিএনপির এই অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত জাতীয় সরকার গঠিত হয়নি। বিভিন্ন মহল বলছে, সে সময় জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে রাজি ছিল জামায়াত এবং হেফাজতের মতো রাজনৈতিক দলগুলো।

জাতীয় সরকারের দ্বিতীয় উদ্যোগটি গ্রহণ করা হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার ঠিক তিন মাস পর। যখন বর্তমান রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি তুলেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ আরো কিছু সংগঠন। তারা এ নিয়ে বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও পালন করেছিল। কিন্তু ওই সময় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, খুব শিগগিরই রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়টি তারা বিবেচনা করে দেখবে। ওই সময় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং তৎকালীন তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম প্রধান বিচারপতি সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে এ ধরনের আশঙ্কা থেকে রাষ্ট্রপতিকে আর অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকেও আপত্তি তোলা হয়।

বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘সেই সময় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ব্যাপারে আমরা বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ এতে দেশে একটি সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হতো।’ রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন নতুন করে কর্মসূচি দিয়েছিল, তখন বিএনপির পক্ষ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তাঁদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন। কোন প্রেক্ষিতে তাঁরা এই অবস্থান গ্রহণ করেছেন সেটিও স্পষ্ট করে বলে দেন। শেষ পর্যন্ত বিএনপির অবস্থানের কারণে সেই সময় রাষ্ট্রপতির অপসারণ সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রপতির অপসারণের মূল পরিকল্পনায় ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠন করা। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং একটি জাতীয় সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। এ ব্যাপারে ড. ইউনূসের আগ্রহ ছিল বলে জানা যায়।

ইদানীং আবার নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে একটি জাতীয় সরকারের মাধ্যমে আরো কয়েক বছর ওই সরকারকে ক্ষমতায় রাখার একটি প্রস্তাব নিয়ে নানা মহলে আলাপ-আলোচনা চলছে। সরকারের একটি অংশের এ নিয়ে প্রবল আগ্রহ রয়েছে বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে। বিভিন্ন দূতাবাসেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে শতাংশ হিসেবে সরকারে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে। জাতীয় সরকারের প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে, যিনি রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করবেন।

বিএনপি থেকে ২৫ শতাংশ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা বর্তমান জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে ২৫ শতাংশ এবং জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আনুপাতিক হারে মন্ত্রিসভায় সদস্য নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব এখন বিভিন্ন মহলে আলোচনার বিষয়। কিন্তু বিএনপি এবারও এ ধরনের প্রস্তাবে রাজি নয়।

বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেছেন, ‘এই সরকার গত ১০ মাসে জনগণকে হতাশ করেছে। কোনো কিছুর সঠিক সমাধান করতে পারেনি। এখন যদি আবার একটি জাতীয় সরকার গঠিত হয়, তাহলে সমস্যা আরো জটিল হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য মনে করেন, বিএনপি এসব ব্যর্থতার দায় নিতে চায় না।

বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এখন দরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কারণ এই সময়ের মধ্যে এটি প্রমাণিত হয়েছে, একটি অনির্বাচিত সরকার দেশের বর্তমান সমস্যা ও সংকট নিরসন করতে সক্ষম নয়। আর এ কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দেওয়া।’

অনেকেই মনে করছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রেখে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সরকার গঠনের ব্যাপারে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক মহল আগ্রহী। তাদের আগ্রহের কারণেই জাতীয় সরকার নিয়ে বিভিন্ন মহলের তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু এই আগ্রহের বিষয়ে সম্মতি নেই বিএনপির। এ কারণেই বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিএনপি দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন তাঁদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর চায়। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীর অনেকে এই মতের সঙ্গে একমত নন। সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কোনো অবস্থাতেই এখন নির্বাচনের পক্ষে নয়।

এনসিপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিচার ও সংস্কারের কথা বললেও বস্তুত সংগঠন গোছাতে তারা জাতীয় নির্বাচন অন্তত তিন বছর পরে চায়। এ জন্যই তারা সংস্কার ও বিচার প্রসঙ্গ সামনে এনেছে। এনসিপির এখনকার দাবি আগে সংস্কারগুলো চূড়ান্ত করতে হবে। চূড়ান্ত সংস্কারের পর নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। যে সংস্কারগুলো হয়েছে সে সংস্কার প্রশ্নে একটি গণভোট করতে হবে। গণভোটের পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হবে। এই জুলাই সনদের ভিত্তিতে একটি নতুন সংবিধান প্রণীত হবে এবং সেই সংবিধান চূড়ান্ত করার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। গণপরিষদ নির্বাচনের পরই কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এনসিপির এই ভাবনায় অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থন রয়েছে বলেও জানা গেছে। এ জন্যই সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় আগ্রহী না। ফলে রাজনীতিতে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কোনো কোনো মহল থেকে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে বলে কোনো কোনো সূত্র দাবি করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি করে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা গেলে বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা সহজ হবে বলেও এনসিপির নেতারা মনে করেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টি এখনো রাষ্ট্রপতিকে মেনে নেয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে নেতিবাচক। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর দুটি শপথ অনুষ্ঠান ছাড়া আর কখনো বঙ্গভবনে যাননি এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎও করেননি। এমনকি বিদেশ থেকে ফিরে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সৌজন্য সাক্ষাৎ করার যে রেওয়াজ রয়েছে, সেটিও তিনি উপেক্ষা করেছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে গত ২৬ মার্চ এবং গত বছর ১৬ ডিসেম্বরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করলেও তাঁদের স্বাভাবিক সৌজন্য বিনিময় বন্ধ ছিল। এমনকি গত রোজার ঈদে প্রধান উপদেষ্টার আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে নামাজ আদায় করতে চাননি। অর্থাৎ বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকেও নেই। তিনি অকার্যকর অবস্থায় আছেন। আর এই সুযোগটি নিতে চায় কোনো কোনো মহল। তারা মনে করে, একটি জাতীয় সরকার গঠন করা গেলে রাষ্ট্রপতিকে হটানো সহজ হবে। যদি ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রপতি হন, তাহলে তিনি সহজেই জুলাই সনদসহ জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন। তবে বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল মনে করছে, এটি আসলে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার একটি অপকৌশল। এর মাধ্যমে তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়। কিন্তু জনগণ সেটি পছন্দ করছে না।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হলে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। নতুন করে আবার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু করতে হবে। এ পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত কি দেশে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হবে, নাকি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? এই প্রশ্নের সমাধান খোঁজা হচ্ছে। মাঠে না হলেও বর্তমানে রাজনীতি হচ্ছে কূটনৈতিকপাড়ায় আর ড্রইং রুমে। দেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিএনপি যদি নির্বাচনের দাবিতে বড় ধরনের জনমত তৈরি করতে না পারে, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে, তাহলে পর্দার আড়ালেই নির্ভর করছে দেশে আসলে কী হতে চলেছে। খবর-দৈনিক কালের কন্ঠ

মন্তব্য করুন


Link copied